ঢাকা আশুলিয়ায় চেকপোস্টেপুলিশ কনস্টেবলকে কুপিয়ে খুন : আহত চার

স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে শিল্প পুলিশের এক সদস্যকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল বুধবার সকালের এ হামলায় আরও চার সদস্য জখম হন। এদের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। নিহত কনস্টেবলের নাম মুকুল হোসেন। তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রহবল গ্রামের শহিদুল ইসলাম ও মুর্শিদা বেগমের ছেলে। ১৯৯২ সালের ২১ ডিসেম্বর জন্ম নেয়া মুকুল ২০১২-এর ২০ সেপ্টেম্বর কনস্টেবল পদে যোগ দেন। এক বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তাকে হারিয়ে দরিদ্র পরিবারে চলছে শোকের মাতম। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য আশুলিয়া থানার এক এসআইকে ক্লোজ করা হয়েছে। তার নাম হাবিবুর রহমান। ক্রাইম সিনের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে গুলির একটি খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, সকাল পৌনে ৮টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে ৩ দুর্বৃত্ত নন্দন পার্কের অদূরে চেকপোস্টে পৌঁছুলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাদের থামতে বলেন। তারা নেমে এসে প্রথমে এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিলে দুর্বৃত্তরা দেশীয় ধারাল অস্ত্র দিয়ে তাদের কুপিয়ে আহত করে। পরে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। ওই সময় পুলিশের হাতে অস্ত্র থাকলেও তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যায়নি। বরং তিন সদস্য পালিয়ে যান।

ঘটনার পর পুলিশ ও ৱ্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। সকাল সাড়ে ১১টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এনাম হাসপাতালে এসে আহত ও নিহতকে দেখেন। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, জঙ্গিদের বিচার কাজ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ ও রায় বাস্তবায়ন কার্যক্রম নস্যাৎ করার জন্য এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতেই জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা এ হামলা চালিয়েছে। তিনি পুলিশ সদস্যদের কর্তব্য পালনের সময় আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। এরপর ঘটনাস্থলে যান তিনি। পরে ৱ্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমদও ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি বলেন, এ হামলা ছিলো পরিকল্পিত। তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য যা করতে হয় করা হবে। প্রয়োজনে গুলির নির্দেশও দেয়া হবে।

এর আগে ২২ অক্টোবর গাবতলীতে এক পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে ইব্রাহিম মোল্লা নামে এক এএসআইকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর ১৩ দিনের মাথায় আশুলিয়ায় এ ঘটনা ঘটল। গুরুতর আহত নূরে আলম সিদ্দিকীর বাড়ি শেরপুরের শ্রীবরদী থানার কুড়িকাহনিয়া গ্রামে। আবদুল বারী ও নার্গিস বেগমের কোলে ১৯৯২-এর ৩০ নভেম্বর জন্ম নেয়া নূরে আলম ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর কনস্টেবল পদে যোগ দেন।

ঘটনার সময় আশুলিয়া থানার এসআই একরাম হোসেনের সেখানে থাকার কথা ছিলো। তবে ঘটনার ১৫ মিনিট পর তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছান। একরাম হোসেন বলেন, পৌনে ৮টার দিকে ৫ পুলিশ সদস্য সেখানে এসে মাত্রই ডিউটি শুরু করছিলেন। দুটি মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন যুবক কালিয়াকৈরের দিক থেকে নবীনগরের দিকে যাচ্ছিলো। পুলিশ সদস্যরা প্রথম মোটরসাইকেলটিকে থামায়। সাথে সঙ্গে দ্বিতীয়টিও থামে। মোটরসাইকেলের কাছে যাওয়া মাত্রই যুবকরা প্রথমে গুলি ও পরে সবাইকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। আহত অবস্থায় মুকুল ও নূর আলম দৌড়ে সড়কের পাশের এক হোটেলে ঢুকে পড়েন। পরে দু যুবক পিছু পিছু এসে ওই হোটেলে ঢুকে আবারও তাদের ছুরিকাঘাত করে। এরপর কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে যায়।

একরাম আরও বলেন, স্থানীয়রা গুরুতর আহত দু পুলিশ সদস্যকে প্রথমে বাড়ইপাড়া ফাতেমা জেনারেল হাসপাতালে নেয়। সেখান থেকে তাদের সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে কিছুক্ষণ পরই মকুল মারা যান।

এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. নাজিম বলেন, মুকুলের ঘাড়ে, বুকে ও পেটে উপর্যুপরি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণেই তিনি মারা যান। নূর আলমের অবস্থাও গুরুতর। তার বুকে ও হাতে ১৩টি কোপের জখম রয়েছে। শিল্প পুলিশ-১-এর এ সদস্যরা ঢাকা জেলা পুলিশের সাথে সংযুক্ত থেকে আশুলিয়া থানার তত্ত্বাবধানে ওই চেকপোস্টে ডিউটিতে ছিলেন। শিল্প পুলিশের আরআই জাকির হোসেন জানান, ওই চেকপোস্টে শিল্প পুলিশের ৫ কনস্টেবল ও আশুলিয়া থানার এক এসআই দায়িত্ব পালন করেন। বুধবার সকালের শিফটের (৮টা থেকে শুরু) দায়িত্বরতরা হলেন- শিল্প পুলিশের কনস্টেবল মুকুল হোসেন, নূরে আলম সিদ্দিক, হারুরুজ্জামান, ইমরান ও ইমরান। পৌনে ৮টায় পুলিশের গাড়ি এদের বাড়ইপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে যায়। জাকির হোসেন আরও জানান, চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যরা আসার পরপরই কয়েক দুর্বৃত্ত এসে তাদের কাছে জানতে চায়- আপনারা রহিমকে চিনেন? এ সময় মুকুল ‘না’ উত্তর দেয়। এ সময় তারা পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিতেই দুর্বৃত্তরা মুহূর্তেই চাপাতি দিয়ে প্রথমে মুকুলের ঘাড়ে ও বুকে পরে নূরে আলমের হাতে ও বুকে কুপিয়ে আহত করে। অন্যদেরও কোপাতে শুরু করলে তিনজন অস্ত্র ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে যান। মুকুল ও নূরে আলম দৌড়ে পাশেই শুভেচ্ছা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েন। দু’জন গিয়ে সেখানেই মুকুল ও নূরে আলমকে কোপায়। তাদের আর্তচিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। জাকির বলেন, নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে এ সময় অন্য পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র ফেলে নিরাপদে আশ্রয় নেয়।

ওই তিন সদস্যকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাদের চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি। ঘটনার পর কালিয়াকৈর ও আশুলিয়া থানা পুলিশ এবং ৱ্যাব-১-এর সদস্যরা ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে। বিকেলে মুকুলের লাশ নেয়া হয় ঢামেক হাসপাতালে। ময়নাতদন্তের পর রাতে সেখানেই তার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এলাকাবাসী জানান, ওই সময় অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিলো। পুলিশ সদস্যদের আর্তচিৎকার ও ছোটাছুটির দৃশ্য দেখে এলাকাবাসী এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করেন। যুবকরা গুলি ছুড়ে এলাকা ত্যাগ করে। পরে লোকজন অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশকে দেয়। আশুলিয়া থানা সূত্র জানায়, সকাল ৮টা পর্যন্ত অপারেশন কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন এসআই হাবিবুর রহমান। তবে তিনি এর আগেই চলে যান। এ কারণে তাকে ক্লোজ করা হয়েছে।

পুলিশ অন্ধকারে: এর আগে গাবতলীতে হামলার ঘটনার মতো বুধবারের ঘটনা নিয়েও অন্ধকারে রয়েছে পুলিশ। তবে বরাবরের মতোই তারা এটিকে জঙ্গিদের কাজ বলে ধারণা করছেন। শিল্প পুলিশের পরিচালক জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়, দুর্বৃত্তরা দেশে নাশকতা তৈরি পুলিশ ও গুণীজন হত্যার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায়। দুপুরে ঘটনাস্থলে যান পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি বলেন, পরিকল্পিত এ ঘটনা ঘটানোরা সবাই প্রশিক্ষিত। তাদের ধরতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, সারা দেশের চেকপোস্ট ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ সময় ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান তার সাথে ছিলেন। তিনি বলেন, উগ্রপন্থী গোষ্ঠী যে এ হামলা চালিয়েছে হামলার ধরন দেখে তা আমরা নিশ্চিত।

শিল্প পুলিশ-১-এর উপপরিচালক কাওসার শিকদার জানান, দুর্বৃত্তরা পুলিশের অস্ত্র ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে, বিষয়টি এলার্মিং। পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান জানান, ধারণা করা হচ্ছে, পুলিশ ও গুণীজন হত্যার মাধ্যমে নাশকতাকারীরা দেশে আতঙ্ক ছড়াতে চাচ্ছে।