আহাদ আলী মোল্লা: নীরবে-নিভৃতেই পরোপারে পাড়ি জমালেন চুয়াডাঙ্গার এক আদর্শ মা কবি মোসাম্মৎ সহিদা খাতুন। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে গতকাল শুক্রবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। গতরাতে বাদ এশা মোমিনপুর গোরস্তানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। আকস্মিক তার এই মৃত্যুতে চুয়াডাঙ্গার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। কবি সহিদা খাতুন গত কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন।
কবি সহিদা খাতুন ছিলেন একজন আদর্শ মা। সামান্য লেখাপড়া জানলেও তার আদর্শ আর স্নেহের কারণে সন্তানদের সবাই একেকজন একেক দিক দিয়ে বিশিষ্টজন। ছোট ছেলে তোসাদ্দুক হোসেন তাসু ছিলেন একজন নামকরা খেলোয়াড়। তার অকাল মৃত্যু হয়। বিয়োগ ব্যথায় সহিদা খাতুন অনেক শোকার্ত হয়ে ওঠেন। তাসু ভালো কবিতাও লিখতেন। ১৯৯৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর ‘কিছু প্রিয় সুখ বুকে পুষছি যেন’ নামের একটি কবিতার বইও বের হয় তার।
মোমিনপুরের সাবেক রেল কর্মকর্তা শেখ জাকির হোসেনের স্ত্রী কবি মোসাম্মৎ সহিদা খাতুন ১৯২৭ সালের ২০ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের ২৪ পরগনা জেলার টিটাগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ আলতাফ হোসেন ও মা মোমেনা খাতুন ওরফে খাদিজা খাতুনের অপার স্নেহে বেড়ে ওঠেন তিনি। তাদের বাড়িতে সে সময় আসা-যাওয়া ছিলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের। কাজী নজরুল ইসলামকে সহিদা খাতুন চাচা বলে ডাকতেন। কবির কোলে-পিঠেও উঠেছেন অনেকবার সহিদা খাতুন। এ কারণেই শিশুকাল থেকেই লেখালেখির প্রতি ঝোঁক জন্মে সহিদা খাতুনের।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৯৪০ সালের ২৮ জানুয়ারি সহিদা খাতুনের বিয়ে হয়। আর সংসার মাত্র ২১ বছর আড়াই মাসের। এরই মধ্যে রেলের বড় বাবু স্বামী শেখ জাকির হোসেন মারা যান। ১০ সন্তানের জননী সহিদা খাতুন নামেন কঠিন এক জীবনযুদ্ধে। ৩ সন্তান শিশুকালেই মারা যায়। বাকি ৭ সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কাজেকর্মে। চাষবাস নিয়ে মাঠে মাঠে দিনভর পরিশ্রম করতেন তিনি। তার সাহায্যের কেউ ছিলো না। অভাবের সংসারে খেয়ে না খেয়েই কাটিয়েছেন অনেক দিন অনেক বছর। একমাত্র খোদার ওপর ভরসা করেই তার লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এভাবে তিনি জীবনের ২৭টি বছর পার করেছেন মাঠে চাষাবাদ করে। কঠোর পরিশ্রম করে। জয়ী হয়েছেন জীবনযুদ্ধে। সত্যি সত্যিই মানুষের মতো মানুষ করেছেন সন্তানদের।
২০০৩ সালে কবি সহিদা খাতুনের এক ছেলে ক্রীড়া অফিসার তোসাদ্দুক হোসেন তাসু মারা যান। অন্যদের মধ্যে ছেলে ইঞ্জিনিয়র শেখ রফিক হোসেন কানাডা প্রবাসী। ছেলে শেখ সফিক হোসেন, শেখ ফারুক হোসেন, শেখ মোশাররফ হোসেন নীলু, মেয়ে নুরুন নাহার ও বদরুন নাহার আসমিরা সবাই আমেরিকা প্রবাসী। সন্তানদের সবাই আধুনিক ও উন্নত জীবন যাপন করলেও স্বামীর ভিটে ছেড়ে থাকেননি এই আদর্শ মা ও কবি সহিদা খাতুন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও তিনি কারোর সাহায্য নেননি। মোমিনপুরের স্বামীর ভিটেয় একলা একাই থাকতেন। একটা কাজের মানুষও রাখেননি তিনি। রান্নাবাড়া থেকে ঘরগেরস্থালির সবই করতেন নিজ হাতে। বার্ধক্য তাকে দমাতে পারেনি কোনোদিন।
কবি সহিদা খাতুন একাকী জীবনে অসংখ্য কবিতা গল্প লিখেছেন। কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক মাথাভাঙ্গাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘স্মৃতির পর্দায়’ ‘নিঃসঙ্গ সহচর’ ও ‘স্বপ্ন গোলাপ’ অন্যতম।
আমেরিকা বা কানাডায় সন্তানদের কাছে যখনই যেতেন তার মন ছটফট করতো দেশের মাটিতে আসার জন্য। এ কারণে সন্তানদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও আমেরিকা বা কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকেননি তিনি। প্রবাস জীবন তার ভালো লাগতো না। তাই কবি সুফিয়া কামালের মতোই তিনি কামনা করতেন জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে মরি যেন এই দেশে। তার এই চাওয়া-পাওয়া আজ সার্থক হয়েছে। গতরাতে বাদ এশা মোমিনপুর কবর স্থানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। সেখানেই চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন কবি সহিদা খাতুন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জেলা লেখক সংঘের সভাপতি ডা. শাহীনূর হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক ময়নুল হাসান। তারা কবির বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন।