বিচার চাই না, বললেই তো আর দেশের প্রচলিত বিধি বিধান উপেক্ষা করা যাবে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহে কর্মরত কর্মকর্তারাও এক্ষেত্রে আইনে বাধা, আইনানুযায়ী বিচারের যাবতীয় পদক্ষেপ তাঁদেরই নিতে হবে। খুনি ধরতে হবে, ধরতে হবে চক্রান্তকারীদের। বিচার করতে হবে। খুঁজতে হবে নৃশংসতা ও আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হওয়ার কারণ। রুখতে হবে একের পর এক খুন, নৃশংসতা।
নৃশংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারানো কারো পিতা বা তার নিকটজনদের কেউ বাদী হয়ে মামলা না করলে বিচার হবে না? না, দেশের প্রচলিত আইন তা বলে না। পুলিশের তরফেই মামলা রুজু করে তদন্তপূর্বক আদালতে অভিযোগ পেশ করতে হবে। আদালত বিচার করবে। আদালতে কোনো আসামি পক্ষ যদি আইনজীবী নিযুক্ত করার মতো সামর্থ্য না হন, তার পক্ষে রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় খরচায় উকিল নিয়োগ করে, করা হয়। এরপরও একজন মুক্তমনের মানুষের বিবেকবান পিতা কেন তার ছেলে হত্যার ‘বিচার চাই না’ বলে ঘোষণা দিলেন? অভিমানযুক্ত ক্ষোভেরই বহির্প্রকাশ নিশ্চয়। এ ক্ষোভ না বুঝে হুট করে শোকার্ত পিতাকে ঘাতকদের দলে ঠেলে দেয়ার মন্তব্য সচেতন সমাজের বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করে। কেননা, অন্যায়ের বিচার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা মূলত সেটাই বলে।
সন্তান হারানোর কষ্ট সহ্য করতে না পারা এবং সন্তানের নিরাপত্তা যে সমাজ বা রাষ্ট্র দিতে পারেনি, সেই সমাজকে ক্ষুব্ধ উক্তিতে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বলেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকে ধরে নেয়া যায়। অবশ্যই প্রশ্ন, দেশে একের পর এক গুণি মানুষ, মুক্তমনের মানুষের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে অথচ খুনের আগে ঘাতকদের ধরে আইনে শনাক্ত করার মতো দক্ষ গোয়েন্দা আমরা গড়ে তুলতে পারছি না। ঘুরে ফিরেই উঠে আসে অপ্রতুলতা। নিরাপত্তার প্রশ্নে অপ্রতুলতা রেখে আর যা-ই হোক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছুনো যায় না। সন্ত্রাস, অসম্প্রীতি সুন্দর সমাজ গঠনে অন্যতম অন্তরায়। তাছাড়া সঙ্ঘবদ্ধ খুনিদের নৃশংসতায় খুন হওয়া প্রকাশক দীপনের পিতা বলেছেন, আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যারা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।’ এ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কি বলা যায়, হত্যাকারীদের আদর্শে বিশ্বাসী বলে দীপনের বাবা বিচার চান না?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ নয়। একজন তার মতবাদ প্রকাশ করলে তাকে হত্যা করতে হবে কেন? সপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনে অন্যের মতবাদকে কি ম্লান করার মতো মেধা ওই খুনিদের নেই। লেখক খুনের পর লেখা প্রকাশের প্রকাশককে হত্যার পর সঙ্গত কারণেই এসব প্রশ্ন আজ অনেকেরই সামনে। তাছাড়া সভ্যতার এতোদিন পরও যখন ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকির মধ্যে পড়ে, ধর্মীয় উন্মাদনায় গুজব রটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, তখন ধর্মীয় সচেতনতার কতোটা অভাব তা উপলব্ধি করতে বেগ পাওয়ার কথা নয়। দেশে ‘আইএস’ আছে, নেই। বিদেশি হত্যার সাথে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাত তা তদন্তকর্তাদের মুখ থেকে বের হওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিতরা যা বলেন, তাতে দেশের সাধারণ মানুষ হতাশ হয়। কেননা, দেশ কোনো একক ব্যক্তির নয়, তেমনই কোনো দলেরও নয়। সকলের। দেশের ভবিষ্যত কোন দিকে যাচ্ছে? একের পর এক নৃশংসতার দৃষ্টান্তমূলক বিচারের পাশাপাশি এ ধরনের খুন রোধ করতে না পারলে গোটা দেশটাই যে জল্লাদখানায় রূপান্তর হবে তা অস্বীকার করবেন কীভাবে?
অবশ্যই দেশে দেশবিরোধী চক্রান্তকারীরা তৎপর। যে দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে, যে দেশে জাত-পাত প্রসঙ্গটাও উবে গেছে প্রায়, সেই দেশে হানাহানি কেন? খুঁজে বের করতে হবে এর জবাব। ঢালাও দোষারোপের বদলে প্রকৃত কারণ খুঁজে সত্যিকারের চক্রান্তকারীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিতে হবে সঠিক পদক্ষেপ।