দীপনকে গলা কেটে খুন : টুটুলসহ ক্ষতবিক্ষত ৩

স্টাফ রিপোর্টার: নিহত লেখক ব্লগার অভিজিত রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে দুর্বৃত্তরা দীপনের জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে তাকে হত্যা করে। প্রায় একই সময়ে অভিজিতের অপর কয়েকটি বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরে হামলা চালানো হয়। শুদ্ধস্বর থেকে অভিজিতের ‘সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ এবং ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ নামের দুটি বই প্রকাশ করা হয়েছিলো। দুপুরে দুর্বৃত্তরা লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ কবি-ব্লগার তারেক রহিম ও ব্লগার-গবেষক রণদীপম বসুকে কুপিয়ে এবং গুলি করে আহত করেছে। আহতদের মধ্যে শুদ্ধস্বর প্র্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল ও কবি-ব্লগার তারেক রহিমের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে রণদীপম বসু আশঙ্কামুক্ত বলে চিকিত্সকরা জানিয়েছেন।
এদিকে আনসার আল ইসলাম নামে একটি টুইটার একাউন্ট থেকে এক টুইটে বাংলাদেশে প্রকাশকদের ওপর হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। নিজেদের আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) দাবি করে ওই টুইটে বলা হয়েছে, ‘আমরা আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা এ অপারেশনের দায় স্বীকার করছি।’
এ হামলার জন্য জঙ্গি বা উগ্রবাদীদের দায়ী করছেন আহতদের তিনজনই। হাসপাতালে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক টুটুল বলেন, ‘অনেকবার আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিলো। এটি জঙ্গি হামলা। অভিজিতের খুনিরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।’ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতির কার্যালয়। গতকাল দুপুরে দীপন একাই সেখানে ছিলেন। দুপুরের কোনো এক সময় ঘাতকরা তাকে কুপিয়ে জখম করে। এরপর তারা প্রকাশনীর বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে যায়। বিকেলের দিকে বিষয়টি জানাজানি হলে তালা ভেঙে সন্ধ্যায় দীপনের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন একই সময় দু প্রকাশকের কার্যালয়ে হানা দিয়েছিলো দুর্বৃত্তরা। দুটি ঘটনায়ই বাইরে থেকে তালা দেয়া হয়েছে। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে টুটুলের সাথে আরো কয়েকজন থাকায় ঘটনাটি তাত্ক্ষণিকভাবে জানাজানি হয়েছে। আর জাগৃতি প্রকাশনীতে দীপন একা থাকায় ঘটনা জানাজানি হতে সময় লেগেছে।
নিহত দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক জানান, দুপুর দেড়টা নাগাদ দীপন বাসায় তার সাথেই ছিলেন। দুপুর পৌনে তিনটার দিকে তিনি কয়েকবার মোবাইলে কল দেন। কিন্তু ছেলে ফোন ধরেননি। বিকেল চারটার দিকে তিনি প্রকাশনীতে যান। ওই সময় কার্যালয়টি ভেতর থেকে বন্ধ অবস্থায় দেখেন। তবে কার্যালয়ের কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো ভেতরে আলো জ্বলছে। ফজলুল হক বলেন, তখন তিনি ছেলে বাইরে গেছে ভেবে সেখান থেকে চলে যান। পরে ছেলের বউকে ফোন করলে জানতে পারেন, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এ কথা শুনে তিনি লোকজন নিয়ে ছেলের কার্যালয়ে গিয়ে দরজা ভেঙে দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় তার ছেলে পড়ে আছে। ওই অবস্থায় দীপনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সন্ধ্যায় চিকিত্সক তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আবুল কাশেম ফজলুল হক আরও বলেন, অভিজিতের বই জাগৃতি থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। এ কারণে হুমকি ছিলো। উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। জাগৃতি প্রকাশনীর ম্যানেজার আলাউদ্দিন জানান, দীপনের গলার পেছনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। রুমে তিনি একাই ছিলেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা ওই কক্ষে ঢুকে তার ওপর হামলা চালায়। শুদ্ধস্বরের মতো জাগৃতিও মুক্তমনা লেখকদের বই প্রকাশ করতো। দু ভাই-বোনের মধ্যে দীপন ছিলেন বড়। দীপন উদয়ন স্কুলে অভিজিতের সাথে পড়েছেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে লেখাপড়া করেন। দীপনের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার রাজিয়া রহমান। তার ছেলে রিদান ফারহান। আজ রোববার থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া রিদানের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা শুরু। আর একমাত্র মেয়ে রিদমা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।
প্রত্যক্ষদর্শী শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর রাসেল এবং বিডিনিউজ পাবলিকেশনসের ওয়াশিফুল হক শক্তি জানান, লালমাটিয়া সি ব্লকের ৮/১৩ নম্বর বাসার চারতলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ের বাইরের রুমে তারা ছিলেন। দুপুর আড়াইটার দিকে এক ব্যক্তি দরজায় নক করেন। তখন রাসেল দরজা খুলে জানতে চান কি দরকারে এসেছেন। মুখে দাড়িওয়ালা ৩৫-৩৬ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি একটি স্লিপ দেখিয়ে বলেন, বই নিতে এসেছি। তার কাছে একটি ব্যাগ ছিলো। ওই ব্যক্তিকে রুমের ভেতর ঢুকতে দিলে তিনি রাসেলকে বলেন, ‘আমার এক ভাই আছে’। তখন রাসেল দরজা খুলে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেন। এ সময় দ্বিতীয় যুবক একটি আগ্নেয়াস্ত্র রাসেলের মাথায় ঠেকিয়ে সোফার ওপর বসতে বলে। এরপর পরই অপর এক যুবক ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই কক্ষে প্রবেশ করে। তখন রাসেল এবং শক্তিকে বাইরের রুমে অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রেখে দাড়িওয়ালা ব্যক্তি ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে এবং তৃতীয়জনসহ প্রকাশনীর অফিস কক্ষে প্রবেশ করে। সেখানে গিয়ে তারা শুদ্ধস্বর প্র্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল ও কবি-ব্লগার তারেক রহিম এবং ব্লগার ও গবেষক রণদীপম বসুকে কুপিয়ে আহত করে। এ সময় তারেক রহিম অফিস কক্ষ থেকে পালিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলে বাইরের রুমে রাসেল এবং শক্তিকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখা দ্বিতীয় ব্যক্তি তারেক রহিমকে বাধা দেয়। এ সময় ওই ব্যক্তি তারেককে লক্ষ্য করে দু রাউন্ড গুলি করে। এর একটি গুলি তারেকের পেটে বিদ্ধ হয়। তার কিছু সময় পর প্রকাশনীর অফিস কক্ষ থেকে ওই দুজন বের হয়ে আসে এবং বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যায়। এ সময় রাসেল আহত টুটুলের মোবাইলফোন থেকে ঘটনাটি টুটুলের বন্ধু দৈনিক সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তাফিজ শফিকে জানিয়ে তাদের উদ্ধারের অনুরোধ জানান। মোস্তাফিজ শফি বিষয়টি পুলিশকে জানান। একই সময় শক্তি ঘটনাটি মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে জানান। খবর পেয়ে পুলিশ তালা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। টুটুলসহ তিনজনকে হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে ভিড় জমে। ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে গণজাগরণ মঞ্চ বিক্ষোভ মিছিলও করেছে।
প্রত্যক্ষদশী ওয়াসিফুল হক শক্তি আরো জানান, হামলাকারীদের তিনজন ফ্ল্যাটটিতে প্রবেশ করে। তবে বাইরে দরজার পাশে আরো দুজন অপেক্ষায় ছিলো। হামলাকারীদের একজনের হাতে পিস্তল ছিলো। তার ১৬-১৭ বছর বয়স। অন্য দুজনের কাছে ধারালো অস্ত্র ছিলো। হামলাকারীরা বলেছিলো, ‘আমরা টুটুলকে মারতে এসেছি’। শুদ্ধস্বরের কার্যালয় ভবনের সামনের একটি দরজি দোকানের কর্মচারী বলেন, ওই ভবন থেকে চিত্কার শুনে আমরা ওইদিকে খেয়াল করে দেখি একটি মোটরসাইকেলে করে তিনজন দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জন কেএম রিয়াজ বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের শরীরে গুলি করা হয়েছে। তাকে হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে। টুটুল ও তারেকের অবস্থা ক্রিটিকাল। তাদের মাথায় গুরুতর আঘাতের পাশাপাশি শরীরে ক্ষত রয়েছে। তবে রণদীপম আশঙ্কামুক্ত।
গত ফেব্রুয়ারিতে অভিজিত নিহত হওয়ার পর টুটুল নিয়মিত ফেইসবুকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন। এ হুমকির ব্যাপারে টুটুল মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মারুফ হাসান বলেন, সিআইডি, পুলিশ এবং ডিবি আলাদা আলাদা তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে তিনজনের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমরা ঘটনাস্থল তদন্ত করে দেখছি।’ তিনি আরো বলেন, ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা গুলি ও খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
র‌্যাব-২’র এডিশনাল এসপি মিজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, লালমাটিয়ায় একটি চারতলা বাড়িতে প্রকাশনীর অফিস। চারতলার প্রথম ও দ্বিতীয় রুমে এ ঘটনা ঘটে। তিনজনকেই কোপানো হয়েছে। এরপর দু রাউন্ড গুলি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।