ছুরিকাঘাতে পুলিশের এএসআই খুন : আরও তিনজন আটক বিস্ফোরক ও বোমা উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার: বার্ধক্যের নানা ব্যাধিতে জর্জরিত। উপার্জনক্ষমতা নেই। ইব্রাহিমই ছিলেন বাবা আবদুস সাত্তার আর মা আছিয়া বেগমের বেঁচে থাকার অবলম্বন। আছিয়া বেগম দিন গুনতেন। মাস শেষ হলে ছেলে টাকা পাঠায়, সেই টাকায় চলে সংসার। কিন্তু হঠাৎ এ কোন সর্বনাশ ঘটে গেলো। একমাত্র ছেলে ইব্রাহিমের মৃত্যু ওলটপালট করে দিয়ে গেলো সাজানো সংসার। মায়ের চোখ ফুলে গেছে বিরামহীন কান্নায়। বাবাও নির্বাক।

রাজধানীর গাবতলীতে গত বৃহস্পতিবার রাতে চেকপোস্টে তল্লাশিকালে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে সহকারী উপপুলিশ পরিদর্শক ইব্রাহিম মোল্লা (৪০) প্রাণ হারান। তিনি দারুস সালাম থানায় কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় মাসুদুর রহমান ওরফে মাসুদ নামে এক যুবককে ঘটনাস্থল থেকেই আটক করা হয়। এ যুবক জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইব্রাহিম হত্যায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। তারাও জামায়াত-শিবিরের কর্মী। একটি সিসিটিভি ফুটেজের সূত্র ও মাসুদের তথ্য অনুযায়ী আরও তিনজনকে আটক করা হয়েছে এ ঘটনায়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

গতকাল শুক্রবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। নিহতের জানাজা শেষে তিনি বলেন, আটক মাসুদ নিজেকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী বলে স্বীকার করেছে। এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। ইব্রাহিম থাকতেন দারুস সালামের বর্ধনবাড়ি এলাকায়। শুক্রবার সকালে ৪৮/৩ নম্বর বর্ধনবাড়ির আল আহসান মঞ্জিলের পঞ্চমতলায় গিয়ে দেখা যায় ইব্রাহিমের পারিবারিক বিভিন্ন সময়ের কিছু ছবি। একটি ছবিতে সন্তানদের জড়িয়ে ধরে আছেন ইব্রাহিম। বিয়ের পরপরই তোলা কিছু ছবি টানানো আছে দেয়ালে। দু কক্ষের এ ফ্ল্যাটে ইব্রাহিম ও খায়রুন্নেসা দম্পতির ছিলো সুখের সংসার। দু সন্তান নিয়ে তারা ভালোই ছিলেন। এলাকায় ইব্রাহিমকে সবাই পুলিশ আঙ্কেল বলে ডাকতেন।

বর্ধনবাড়িতে ইব্রাহিমের বাড়ির খোঁজ করতে গেলে আলামিন নামে এক কিশোর বলে, পুলিশ আঙ্কেল খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ওই এলাকায় শিশু-কিশোর এবং একাধিক নারী-পুরুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইব্রাহিম খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। এলাকার মুরব্বিদের সালাম দিতেন। শিশু-কিশোরদের খুব আদর করতেন। তাদের কাছে তার পরিচয় ছিলো, পুলিশ আঙ্কেল। সংবাদকর্মী ঘটনাস্থলে এসেছে শুনে দোতলা থেকে নেমে আসেন আল আহসান মঞ্জিলের মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি বলেন, ইব্রাহিম তার বাসায় দেড় বছর ধরে আছেন। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। কোনো ঝামেলার মধ্যে ছিলেন না। ওই বাসার আরেক ভাড়াটিয়া আঞ্জুমান আরা বলেন, ইব্রাহিম ভাই ছিলেন একজন সরল মানুষ। আর ভাবিরও কোনো অহঙ্কার ছিলো না। দুজনে বেশ মিশুক ছিলেন।

এদিকে ছুরিকাঘাতে নিহত এএসআই ইব্রাহিমের বাগেরহাটে কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামে চলছে শোকের মাতম। তার এমন মৃত্যুর খবর কারোই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। পারিবারিক সূত্র জানায়, আবদুস সাত্তার মোল্লার ছয় সন্তানের মধ্যে ইব্রাহিম ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ইব্রাহিম ছিলেন সবার আদরের। সেই একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ইব্রাহিমের মা-বাবা এখন পাগলপ্রায়। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে গ্রামের বাড়িতে ছুটে এসেছেন বড় চার বোন জাহানারা বেগম, আনোয়ারা বেগম, মনোয়ারা বেগম ও হোসনে আরা বেগম। বিধবা বড় বোন জাহানারা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ইব্রাহিম ছিলো আমাদের পরিবারের প্রদীপের মতো। বৃদ্ধ বাবা-মাসহ অসহায় বোনদের ওই আগলে রাখতো। ওর ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে, ওগো কি হবে, ওরা কিভাবে বাঁচবে, ওগো কেডা মানুষ করবে।

বাবা আবদুস সাত্তার বলেন, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে পালপাড়া এলাকার এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে তিনি ছেলের মৃত্যুর খবর পান। স্ত্রীকে কিভাবে এ খবরটা জানাবেন বুঝতে পারছিলেন না। পরে অবশ্য লোকজনের ভিড় জমে গেলে পরিবারের সবাই জানতে পারে, তাদের ইব্রাহিম আর নেই। সকালে আত্মীয়-স্বজনরাও ইব্রাহিমের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বোনদের সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন। স্বজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পালপাড়া গ্রাম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, পুলিশ সদস্য ইব্রাহিমের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে স্বজন ও সহকর্মীদের কাছে হস্তান্তরও করা হয়। এরপর জুমার নামাজের পর জানাজা শেষে ইব্রাহিমের লাশ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে লাশ পৌঁছার পর দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ইব্রাহিমের সেজো বোন মনোয়ারা বেগম জানান, ইব্রাহিমের দু সন্তানের মধ্যে বড়টি হচ্ছে তার ৬ বছর বয়সী মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসী। ছেলে পরাগের বয়স দেড় বছর। কনস্টেবল পদে পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের পর বিভিন্ন থানায় কর্মরত থাকাকালে সাহসিকতা ও সততার জন্য ইব্রাহিম কিছুদিন এলিট ফোর্স ৱ্যাবেও কাজ করার সুযোগ পান। ধাপে ধাপে উন্নীত হন এএসআই পদে।

ইব্রাহিমের বাবা আবদুস সাত্তার বলেন, জনগণের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে কর্মরত অবস্থায় তার ছেলে খুন হয়েছে। তিনি সরকারের কাছে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। পাশাপাশি ইব্রাহিমের ছেলেমেয়ের সার্বিক দায়িত্ব নেয়ারও অনুরোধ জানান।

আরও তিনজন আটক : এএসআই ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডে একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপ জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। শুক্রবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ইব্রাহিমের জানাজা শেষে আইজিপি সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। তার ভিত্তিতে কামরাঙ্গীরচরে অভিযান চালিয়ে আরও তিনজনকে আটক করা হয়। এখনও হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে অভিযান চলছে। মনে হচ্ছে তারা একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপ। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না। এএসআই নিহতের ঘটনাটি ডিবি ও থানা পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত করছে বলে জানান তিনি।

ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, মাসুদের তথ্য মতে আমরা কামরাঙ্গীরচরে অভিযান চালিয়ে প্রচুর বিস্ফোরক ও বোমা উদ্ধার করেছি। গাজীপুরের অভিযান চালানো হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তেই বোঝা যাবে এর পেছনে কারা জড়িত।