ইউনেস্কো প্রতিবেদন : প্রাথমিকের ২২ ভাগ শিক্ষার্থী নীরবে স্কুল ছাড়ছে

স্টাফ রিপোর্টার: স্কুলে ভর্তির পর প্রায় ২২ ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্তরের লেখাপড়া শেষ করতে পারে না। শিক্ষা পদ্ধতির মৌলিক দুর্বলতা শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধিসহ ছয়টি প্রধান কারণে এসব শিক্ষার্থী নীরবে বাদ পড়ছে। ইউনেস্কো প্রণীত ‘সবার জন্য শিক্ষা জাতীয় পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এটি কাল রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের অন্য দেশের ইএফএ চিত্রও (বৈশ্বিক) প্রতিবেদনটিতে স্থান পেয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ২০০০ সালের ডাকার ঘোষণায় সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতে ৬টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ ইএফএ লক্ষ্য কতোটুকু অর্জন করলো তা পর্যবেক্ষণ করে পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন প্রায় প্রতিবছরই ইউনেস্কো প্রকাশ করে। বাংলাদেশের পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রতিবেদনও আমরা এবার প্রকাশ করবো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষায় বাংলাদেশের অর্জনের তথ্যচিত্র সংশ্লিষ্ট শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় তৈরি হয়েছে।

ইউনেস্কোর এ নীরবে বাদ পড়ার বিষয়টিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ঝরে পড়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত আগস্টে সরকারি এ প্রতিষ্ঠান বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৪ সালের বিভিন্ন তথ্যের ওপর পরিচালিত ওই শুমারি অনুযায়ী প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিলো প্রায় ২১ শতাংশ।

ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের নীরবে প্রাথমিক স্কুল ত্যাগের এ চিত্র বৈশ্বিক পরিস্থিতির তুলনায় উদ্বেগজনক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২০ ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্কুলের শেষ শ্রেণিতে পৌঁছাতে পারে না। এক্ষেত্রে ৩২টি দেশের তথ্য যাচাই করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থী স্কুলে গিয়েও প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে না পারার পেছনে বিশ্বব্যাপি ৯টি কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- শিখন-শিখানো পদ্ধতির মৌলিক দুর্বলতা, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, বিলম্বে ভর্তি, দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকার প্রতিকূলতা, এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব, শিক্ষায় প্রবেশাধিকার, অংশগ্রহণ এবং শহরে বস্তির সমস্যা। তবে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ও বিলম্বে ভর্তির সমস্যা বাংলাদেশে তেমন নেই। এক্ষেত্রে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার জন্য বাকি সাতটি কারণই দায়ী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপি প্রাথমিকে ভর্তি অনুপাত বেড়েছে। কিন্তু এরপরও ২০১২ সালে বিশ্বে ৫ কোটি ৮০ লাখ শিশু স্কুলের বাইরে ছিলো। এ সংখ্যা কমানোর অগ্রগতি বর্তমানে স্থবির। প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করার কথা বলছে সংস্থাটি। এজন্য এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে তারা। পাশাপাশি সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রান্তিকতার সমস্যা সমাধানের পরামর্শও দেয়া হয় প্রতিবেদনে। তারা প্রান্তিক সমস্যা হিসেবে ৬টি বিষয় চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে- সংঘাত, শ্রমজীবী, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা-ভাষাভাষীর মানুষ, এইচআইভি এবং গ্রামাঞ্চলের মেয়েশিশু। দরিদ্র এবং বস্তির শিশুও এ প্রান্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বলা হয়, সবার জন্য শিক্ষার ৬টি লক্ষ্য অর্জনে ১৮টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অপরদিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে রয়েছে ২৪টি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইউনেস্কো ২৩টি সুপারিশ করেছে।

ইএফএ ৬ লক্ষ্য ও বাংলাদেশ : ইএফএ’র প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, প্রাক-শৈশবকালীন যত্ন ও শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, সম্পদের সমাবেশীকরণ ও স্কুলের জন্য পর্যাপ্ত স্থানের অভাব। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ এবং শিশুর জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করাসহ ৫টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে- সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা। বাংলাদেশে আগের চেয়ে স্কুলে শিশু ভর্তি বেড়েছে। বিনামূল্যে পাঠ্যবই ও উপবৃত্তি দেয়া, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন না করার হার অনেক বেশি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত মাত্র ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছে। ইউনেস্কো মনে করে, এ ক্ষেত্রে ৩টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- শিখন-শিখানো প্রক্রিয়ার কারণে অনেকে নীরবে বাদ পড়ছে।

মানদণ্ড অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত নেই। বেসরকারি রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ও আরেক চ্যালেঞ্জের কারণ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে ৫০ ভাগ বৃদ্ধিসহ (নিয়োগ) ৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, দক্ষতা ও নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে ২টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মোকাবেলায় ৫টি সুপারিশ করা হয়েছে। বয়স্ক শিক্ষা ও সাক্ষরতা ইএফএ’র চতুর্থ লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে ৩টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। তৃণমূলে স্থায়ী কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার এবং রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করাসহ ৫টি সুপারিশ করা হয়েছে। পঞ্চম লক্ষ্য হচ্ছে- শিক্ষায় জেন্ডার সমতা। এ ক্ষেত্রে ৫টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ৩টি সুপারিশ রয়েছে। সবশেষ লক্ষ্য হচ্ছে- মানসম্মত শিক্ষা। এরজন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার পরও ৩টি চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করছে ইউনেস্কো। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সমতাভিত্তিক ও একীভূত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতসহ অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।

এছাড়া বৈশ্বিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১০টি সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে- শৈশবকালীন যত্ন ও শিক্ষায় গুরুত্বারোপ, সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনে সক্ষম করে তোলা, যুব ও বয়স্কদের মধ্যে কর্ম ও জীবন দক্ষতা অর্জনপ্রবণতা উন্নত করা, সাক্ষরতা ও গণিত বিষয়ে জ্ঞানের অধিকার আদায়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের সক্ষম করে তোলা, জেন্ডার সমতা থেকে সরে এসে বৈষম্যহীনতার ওপর গুরুত্বারোপ, শিক্ষার মানোন্নয়নে বিনিয়োগ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা সহায়তা ও সম্পদ বৃদ্ধি করা, সমতার ওপর গুরুত্ব জোরদার, পরিবীক্ষণ আরও উন্নত করতে তথ্যের অভাব পূরণ এবং শিক্ষার জন্য উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সমর্থন ধরে রাখতে সমন্বয়বিষয়ক চ্যালেঞ্জ উত্তরণ।