আকাশে শুভ্রমেঘের দল, বাতাসে শিউলির সুবাশ। এসবই দেয় শরতের ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণই প্রতি বছর মনে করিয়ে দেয় এসেছে শারদীয় উৎসব। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উত্সব শারদীয় দুর্গাপূজা। এ উৎসব ছড়ায় সবার মাঝে।
রামায়ণ অনুসারে, অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন ঘটে বিধায় তার এ বোধনকে অকালবোধনও বলা হয়। বলা যায়, যুদ্ধে জয়লাভ করার অভিলাষ থেকেই দেবীর এ অকালবোধন বা আবির্ভাব। কথিত আছে, বনবাসী রামচন্দ্র স্বর্ণলঙ্কার রাক্ষসরাজ রাবণের নিকট হতে প্রিয়তমা স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করবার বাসনায় অসময়ে, অর্থাৎ বসন্তকালের পরিবর্তে শরত্কালে দেবীকে বোধন করেন এবং এইভাবে প্রচলন ঘটে শারদীয় দুর্গাপূজার। দুর্গাপূজা দুভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে- ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে এলাকা এলাকায়, যা সর্বজনীন দুর্গোত্সব নামে পরিচিত। মহালয়ার দিন হতে মণ্ডপে-মণ্ডপে দেবী দুর্গা ও তার সন্তানদের শরীরে খড়-মাটির প্রলেপ দেখার আনন্দ নিছক কৌতূহল-মাত্র নয়। সামান্য খড় ও মাটি হতে কী করে পরতে পরতে অপূর্ব সুন্দর মূর্তি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে- সেই সৃষ্টিরহস্য নিজ-চোখে আবিষ্কারের আনন্দ সকল শৈশবমনে এক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। জানা যায়, সর্বজনীন পূজার উদ্ভবের ইতিহাসের সাথে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেবী দুর্গাকে বলা হয় মাতৃশক্তির প্রতীক। এ শক্তি শৈবশক্তি। দেবীর এ রূপ লোকায়ত এবং বাস্তবতার বিশেষ প্রতিফলন বলা যায়। দেখা যায়, দেবী দুর্গার সংহারমূর্তি আর মাতৃমূর্তির মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। অসুরদমনের সময়ও তিনি সন্তানসন্ততি, এমনকী পতিকেও সাথে রেখেছিলেন। আবার ধরাধামে মানবমঙ্গলের জন্য এসেও তিনি শত্রু অসুরকে সাথে আনতে ভোলেননি। বৈপরীত্যের ঐক্য নিয়েই তার এ প্রকাশ। রামের সেই যুদ্ধ যেমন অশুভ শক্তির প্রতিভূ অসুরের বিরুদ্ধে, ঠিক তেমনি দুর্গত দেবতাদের সপক্ষেও। ব্যক্তি মানুষের মধ্যে, সমাজের মধ্যে অসুররূপী যে পশুত্ব রয়েছে, তা থেকে মনুষ্যত্বে উত্তরণের যে চিন্তা সমাজ-জীবনে প্রবহমান, সেই চিন্তারও প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায় দুর্গাপূজার মধ্যে। সে কারণে দুর্গা দেবী হলো শুভশক্তির আরাধ্য দেবী।
যুগ যুগ ধরে বাংলার প্রায় প্রতিটি জনপদে অন্যসব সম্প্রদায়ের মানুষেরাও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোত্সবের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পৃক্ত করেন নিজেদের। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যও একটি দেশের বড় সম্পদ। বৈচিত্র্যতাকে সম্মান করা দায়িত্বেরই অংশ। সকলকে শারদীয় দুর্গোত্সবের শুভেচ্ছা।