স্টাফ রিপোর্টার: স্কুলে ভর্তি যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ভর্তি পদ্ধতিতে আনা হচ্ছে বড় ধরনের পরির্বতন। এলাকার শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনার আলোকেই সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের ভর্তি নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে এলাকাভিত্তিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে বিভিন্ন মহল দাবি করে আসছেন। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে এ দাবি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে মৌখিক নির্দেশনা দেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) কাজ শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, সব মহানগরী ও জেলা পর্যায়ের স্কুলে সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে ৪০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে নীতিমালা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী নভেম্বরে প্রথম শ্রেণি থেকে মাধ্যমিকের সকল শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম শুরুর আগেই নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্র জানায়, এমনিতেই দেশে মানসম্মত স্কুলের সংখ্যা অনেক কম। সারাদেশে একই মানের প্রতিষ্ঠান না থাকায় পুরোপুরি এলাকাভিত্তিক স্কুলিং সিস্টেম চালু করা সম্ভব নয়। এছাড়া প্রতিযোগিতা ছাড়া স্থানীয় শতভাগ শিক্ষার্থীকে তার এলাকার প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ দেয়াও অসম্ভব। কারণ যদি ভিকারুননিসা নূন বা মতিঝিল আইডিয়ালে সে সুযোগ দেয়া হয় তাহলে ওই এলাকার শ শ শিশু ভর্তি হবে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানের সেই পরিমাণ আসন নাও থাকতে পারে। অপরদিকে একটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ অন্য এলাকার একজন শিশু নাগরিক তার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে। এতেও এক ধরনের নাগরিক বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এ সুযোগে একটি শ্রেণি ভালো প্রতিষ্ঠানের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে সুবিধা আদায়ের সুযোগ নেবে। তাই এসব সমস্যার কথা মাথায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে ভর্তি পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে সামনে রেখেই বিদ্যালয় এলাকার শিক্ষার্থীকে ভর্তিতে অগ্রাধিকার দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে যে যে সমস্যা সামনে চলে আসবে আপাতত সেগুলো নিয়েই কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ রেখে ভর্তি পদ্ধতিতে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কারা স্থানীয় নাগরিক বা বাসিন্দা, কতদিন আগে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করলে স্থানীয় বলে বিবেচিত হবেন, এলাকা বলতে কতদূরের নাগরিক হবেন_ এ ধরনের যত অনিয়ম ও সমস্যা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতেই আপাতত কাজ চলছে।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে একটি প্রস্তাব প্রস্তুত করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এলাকার শিশুদের ভর্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে তারা কাজ করছেন। তারা চান, স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভর্তির সময় স্থানীয় শিক্ষার্থীর জন্য ৪০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখতে। কারণ শহরের ভালো প্রতিষ্ঠানের দিকেই শিক্ষার্থীর মা-বাবার আগ্রহই বেশি। সেজন্য এখানে প্রতিযোগিতাটাও বেশি হয়। তাই তারা মহানগরী ও জেলা শহরকে এই পদ্ধতির মধ্যে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কারা হবেন ভালো প্রতিষ্ঠানের আশপাশের এলাকার বাসিন্দা এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাড়া থাকা বা নিজ বাসা সকলেই এলাকার বাসিন্দা। তবে যদি ভাড়াটিয়া হলেই ভর্তির সুযোগ পায় তাহলে তো পাল্লা দিয়ে সবাই ভালো প্রতিষ্ঠানের আশপাশে ভাড়া নেয়া শুরু করবেন। অনেকে সন্তানকে ভর্তির কদিন আগে ওই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করবেন। এই সুযোগে অনেক প্রতিষ্ঠানের আশপাশে বাসা ভাড়াও বাড়িয়ে দেবেন বাড়ির মালিকরা। তাই যখন তখন বাসা ভাড়া নিলেই হবে না। কতদিন আগে থেকে বসবাসকারী হবে কিংবা কি কি প্রমাণ লাগবে তার সবই তারা আলোচনা করে চূড়ান্ত করবেন। এটা হবে তাদের অধিদফতরের ক্যাচমেন্ট এরিয়া।
তিনি আরো বলেন, আগামী নভেম্বরে স্কুল ভর্তি কার্যক্রম শুরুর আগেই নীতিমালায় ৪০ শতাংশ কোটা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে ভর্তির সময়েই যেন এটি কার্যকর হয়। মূলত শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষত স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও এলাকাভিত্তিক স্কুলিং সিস্টেম চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন। দুর্বিষহ যানজট, অর্থ-শ্রম ও সময়ের অপচয়, মৌলিক শিক্ষায় ত্রুটি, ঝরেপড়া রোধ, শ্রেণি-বৈষম্যসহ অনেক সমস্যার সমাধানের জন্যই এলাকাভিত্তিক স্কুলের দাবি উঠেছে। এরমধ্যে অনেক শিক্ষক সংগঠনেরই দাবি হচ্ছে, প্রথম শ্রেণিতে যেহেতু ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই লটারির মাধ্যমে ভর্তি হয়, সেহেতু লটারিটাও যেন হয় শিশুর সনি্নকটস্থ স্কুল ক্যাম্পাসেই। এটা হলে বারিধারার শিশুরা ভিকারুননিসার বেইলি রোডের শাখায় যাবে না, অথবা ধানমন্ডির শিশুরা বারিধারা বা সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে গিয়ে লটারিতে অংশ নেবে না। যার বাসা-বাড়ি স্কুলের যত কাছে, ভর্তির ক্ষেত্রেও নিকটস্থ স্কুলে তার তত অগ্রাধিকার থাকা উচিত। এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের মাধ্যমে সময়-শ্রম ও অর্থের অপচয় বন্ধ হবে, অন্যদিকে অভিভাবকের প্রতিদিনের টেনশনও কমবে। গাড়ি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি কিংবা হৈ হুল্লোড় থাকবে না। রাস্তায় যানজট ও দুর্ঘটনা কমবে। এছাড়া তেল ও গাড়ি আমদানিতে সরকারের ব্যয় হ্রাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও খাতে জাতীয় অপচয় বন্ধ হবে। সন্তানের জন্য বাবা-মার অফিসের গাড়ি বরাদ্দের দুর্নীতও বন্ধ হবে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শ্রম ও সময়ের অপচয় রোধ হবে। দূরবর্তী স্থানে যাতায়াত করতে হবে না বলে ঝরে পড়ার হার কমবে।
উল্লেখ্য, গত ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবস এবং ১১ অক্টোবর বিশ্বশিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্কুলে শিশুদের ভর্তি নিয়ে কথা বলেন। উভয় অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী স্কুল ভর্তি বিশেষত প্রথম শ্রেণিতে শিশুদের ভর্তিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্লাস ওয়ানে ছাপানো প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হবে কেন? যখনই একটা শিশুর ভর্তির বয়স হবে তখনই তাকে ভর্তি নিতে হবে। শিক্ষা তার মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একটি শিশু যদি ছাপানো প্রশ্নপত্র পড়ার মতো জ্ঞানই অর্জন করে থাকে, তাহলে তাকে আর স্কুলে পড়াবে কী?