স্টাফ রিপোর্টার: মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির জন্য দু দেশের মধ্যে প্রায় ছয় বছর ধরে একের পর এক শুধু উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে। কিন্তু শীর্ষ ওই শ্রমবাজারের বন্ধ দুয়ার বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে না। সরকারিভাবে পাঁচ বছরে ৫ লাখ শ্রমিক পাঠানোর সেই বহুল আলোচিত ঘোষণাও আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর বেসরকারিভাবে জনশক্তি রফতানির (বিটুবি) আলোচনা চলছিলো। এরই মধ্যে আকস্মিকভাবে চলে আসে সরকার চাইলে বেসরকারি রপ্তানিকারকদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে (জিটুজিপ্লাস) পারবে।
তবে দু দেশের মধ্যে সর্বশেষ নেয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে মালয়েশিয়ার একটি সিদ্ধান্ত, যার মাধ্যমে দেশটির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কয়েকটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজশ করবে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাতসংশ্লিষ্টরা। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) অভিযোগ, মালয়েশিয়া ‘সিনারফ্লক্স এসডিএন-বিএইচডি’ নামে সে দেশের একটি ‘বিতর্কিত’ প্রতিষ্ঠানকে কর্মী পাঠানোর কাজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়েছে। ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া বায়রার চিঠিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ার এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গুটি কয়েক লাইসেন্সে কাজ করার সুযোগ পাবে। এতে আরও বলা হয়, ‘এতে করে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে একচেটিয়া মুনাফা লোটার ও প্রতারণার অভিপ্রায় লক্ষ করা যাচ্ছে। জানতে চাইলে বায়রার সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাসার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেয়ার কথা স্বীকার করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বায়রার সদস্য প্রায় ১ হাজার ২০০, কিন্তু মালয়েশিয়ার ওই প্রতিষ্ঠান জনশক্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেলে বাংলাদেশের ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া সুবিধা পাবে। জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানসচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার বলেন, বিশেষ কেউ সুবিধা পাবে, এমন কোনো তথ্য তাঁর কাছে নেই। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি পর্যায়ে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি ‘ব্যর্থ’ হওয়ার পর বেসরকারি পর্যায়ে জনশক্তি রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তও পরিবর্তন হয়েছে। এখন জিটুজিপ্লাস পদ্ধতিতে জনশক্তি রপ্তানির সিদ্ধান্ত হয়েছে, যার মূল কথা সরকার চাইলে বেসরকারি রপ্তানিকারকদের এ কাজে যুক্ত করতে পারবে।
এ লক্ষ্যে মালয়েশিয়া সরকার গত মাসে কর্মী পাঠানোর কাজটি ব্যবস্থাপনার জন্য ‘সিনারফ্লক্স এসডিএন-বিএইচডি’ নামে সেখানকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগের সিদ্ধান্ত সংশোধন করে নতুনভাবে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আলোচনা চলছে। দীর্ঘদিন বন্ধের পর গত জুনে বাংলাদেশ থেকে বেসরকারিভাবে জনশক্তি নেয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া। প্রাথমিক পর্যায়ে কর্মী পাঠানোর কাজটি বেসরকারি পর্যায়ে (বিজনেস টু বিজনেস পদ্ধতি) হওয়ার কথা আলোচনা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সরকারের অধীনে বেসরকারি রপ্তানিকারকদের যুক্ত করে (জিটুজিপ্লাস) কর্মী নেয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া। গত মাসে এই প্রস্তাব নিয়ে মালয়েশিয়ার একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এলে নতুন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামও এই প্রস্তাবে রাজি হন।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মালয়েশিয়া হাইকমিশন ও বায়রার সূত্রগুলো বলছে, এ রকম পরিস্থিতিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশনকে চিঠি দিয়ে জানায়, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার (বিডব্লিউএমএস) কাজটি বাস্তবায়ন করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সিনারফ্লক্স এসডিএন-বিএইচডি’। ব্যবস্থাপনার কাজটির জন্য তারা বাংলাদেশে ও মালয়েশিয়ায় সেবাকেন্দ্র চালু করবে। তারাই কর্মীদের মেডিকেল ও নিবন্ধনের কাজ তদারক করবে। বাংলাদেশি নাগরিক কর্মীদের ভিসা প্রক্রিয়ার কাজটিও করবে তারা। প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে ভিসা স্টিকার অনুমোদনের জন্য মালয়েশিয়া হাইকমিশনে পাঠাবে এবং তা ফেরতও দেবে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের একাধিক সূত্রমতে, মালয়েশিয়ার ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে রয়েছেন সেখানকার সাবেক একজন মন্ত্রী এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক ব্যক্তি।
বায়রার সহসভাপতি আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ থেকে ১৪২টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হয়। কিন্তু কোথাও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়নি। তাহলে বাংলাদেশের বেলায় কেন এমনটি করা হবে। এতে সমস্যা বাড়বে। বিষয়টি নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও অস্বস্তিতে আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে তাঁরাও জেনেছেন ‘সিনারফ্লক্স’ নামের একটি কোম্পানি কর্মী নিয়োগের বিষয়টি দেখবে। তবে চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না ওই প্রতিষ্ঠানই ব্যবস্থাপনার কাজটি করবে।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে ২০০৭ সালে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ জন এবং ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন শ্রমিক গিয়েছিলেন। কিন্তু নানা অনিয়ম ও প্রতারণার কারণে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয় দেশটি। এরপর ২০১২ সালের নভেম্বরে দু দেশের মধ্যে সরকারিভাবে কর্মী নেওয়ার চুক্তি হয়। তখন মালয়েশিয়া ৫ লাখ কর্মী নেওয়ার আশ্বাস দেয়। এ নিয়ে সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের (বর্তমানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী) আশ্বাসে মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার লোক নিবন্ধন করেন। সরকারের সফলতা হিসেবে বিষয়টি ব্যাপক প্রচারও পায়। নাম নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই কেবল ৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু গত তিন বছরে পাঠানো গেছে মাত্র প্রায় আট হাজার শ্রমিক।
সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, সরকারিভাবে কম টাকায় লোক নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলেও মালয়েশিয়া পর্যাপ্ত চাহিদাপত্র পাঠায়নি। বেসরকারি জনশক্তি রপ্তারিকারকেরাও ভেতরে ভেতরে সরকারি পর্যায়ে কর্মী পাঠানোর বিরোধিতা করতে থাকে। সরকারও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারায় ব্যর্থ হয় সরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানি। সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এটা সত্য যে, এর অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো নয়।
সম্প্রতি সাগরপথে মানব পাচার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক লোক নেয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, সরকারি পর্যায়ে লোক পাঠানো হলে একেকজনের ৩৬ থেকে ৩৭ হাজার টাকা খরচ পড়বে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করলে খরচ হবে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। আগে সরকারিভাবে জনপ্রতি ৩৩ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া গেছেন।