মেহেরপুর জেলায় ডাল ও শস্য আবাদে বীজ শোধন কার্যক্রম শুরু

 

মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর জেলার কৃষিতে শুরু হয়েছে ডাল ও তৈল জাতীয় বীজ শোধন কার্যক্রম। গত বছর শোধনকৃত বীজ বপনে আবাদ খরচ হ্রাস ও উৎপাদন বৃদ্ধি হয় আশানুরূপ। ফলে এবারের রবি মরসুমে শতভাগ জমিতে শোধনকৃত বীজ বপনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে কৃষি বিভাগ। মেহেরপুর জেলায় গত বছর ৬ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে মসুর ও ৬ হাজার ৮১৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়েছিলো। প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন হয়েছিলো মসুর ১ দশমিক ৫ মেট্রিক টন এবং সরিষা ১ দশমিক ৩৮ মেট্রিক টন। শোধনকৃত বীজ বপন করা গেলে এ উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে আশার কথা কথা জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

অপরদিকে বীজ, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাত্রাও কমে আসবে। ফলে অল্প খরচেই কাঙ্খিত উৎপাদন পাবেন কৃষকরা। তাছাড়া দেশের যে বাজার ব্যবস্থাপনা তাতে কৃষকরা অনেক সময় নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ কারণে কৃষকদের লোকসান কমাতে প্রথমত উৎপাদন খরচ হ্রাসের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার মাজেদুল ইসলাম জানান, বীজ শোধন করে বপন করা হলে ডাল ও তৈল জাতীয় ফসলের চারা অবস্থায় সিডলিং ব্লাইড বা চারা মারা যাওয়া বন্ধ হয়। ফলে সিডলিং ব্লাইড ঠেকাতে ক্ষেতে ছত্রাক নাশক স্প্রে করতে হয়না। এ অঞ্চলের চাষিরা মসুর ও সরিষা আবাদে এক মরসুমে অন্তত তিন বার ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করে থাকেন যার খরচ প্রায় এক ১ হাজার ২শ টাকা। কৃষকরা প্রতি বিঘায় মসুর বীজ আট কেজি ও সরিষার বীজ চার কেজি বপন করে থাকেন। শোধনকৃত বীজ বপনে চারা মরা বন্ধের ফলে কৃষকের প্রচলিত হিসেবের থেকে ৪০ ভাগ বীজ কম বপন করতে হয়।

শুধু বীজ ও ছত্রাকনাশকের খরচ সাশ্রয়-ই নয়, শোধনকৃত বীজ বপনের ফলে ফসল থাকে সতেজ ও রোগমুক্ত। যার ফলে অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করতে হয় না এবং উৎপাদন বেড়ে যায়। চারা মরা রোধের ফলে প্রায় শতভাগ গাছ থেকেই ফলন পাওয়া যায়। গত রবি মরসুমে গাংনী উপজেলার নিত্যানন্দপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষক বীজ শোধনের সফলতা পেয়েছেন। সুফলভোগী চাষি লুক মণ্ডল জানান, তার এক বিঘা জমিতে ১২ মণ মসুর ফলন হয়েছিলো। কিন্তু তার ক্ষেতের পার্শ্ববর্তী চাষিরা যারা বীজ শোধন ছাড়াই বপন করেছিলেন তাদের বিঘায় উৎপাদন হয়েছিলো ৭-৮ মণ। ওই চাষিদের চেয়ে লুক মণ্ডলের উৎপাদন খরচও কমেছিলো।

আরেক সফল চাষি প্রবীর মণ্ডল জানান, গত মরসুমের সফলতার পথ ধরে এবারে তার ও আশেপাশের গ্রামের প্রায় সব চাষিই বীজ শোধনে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কৃষি অফিসের পাশাপাশি তাদের কাছেও চাষিরা শোধন পদ্ধতি ও সফলতা সম্পর্কে জানতে আসছেন। চাষিরা জানান, দিনে দিনে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে হরমোন, ছত্রাকনাশক, ভিটামিন ও কীটনাশক প্রয়োগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিরা ক্ষেতে গিয়ে এসব প্রয়োগে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছেন। ফলে চাষিরাও এসব প্রয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে না উপরন্ত আবাদ খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, হরমোন ও ভিটামিনের ব্যবহারে তাৎক্ষনিক ক্ষেতের ফসলের চেহারা পরিবর্তন হয়ে দৃষ্টিনন্দন দেখায়। ফসলের এ রুপ দেখে চাষীরা তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। গাছ দেখতে ভাল লাগলেও এতে কোনভাবেই উৎপাদন বৃদ্ধি পায়না। ডাল ও তৈল জাতীয় ফসল চাষে চাষিরা প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত তিন হাজার টাকার হরমোন, ভিটামিন ও কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। এতে স্বাভাবিক খরচের চেয়ে উৎপাদন খরচ দু থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এ জাতীয় ফসল চাষে শোধনকৃত বীজ বপন করা গেলে প্রতি বিঘায় শুধুমাত্র ২০ কেজি টিএসপি এবং ৫ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলেই চলে। ফুল আসা শুরু হলে কুয়াশার ক্ষতি ঠেকাতে একবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। কিন্তু কোম্পানির প্রতিনিধিদের পরামর্শে বিভ্রান্ত চাষিরা যত্রযত্র রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বীজ শোধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার মাজেদুল ইসলাম জানান, শুকনো বীজ গামলা জাতীয় একটি পাত্রে রেখে সামান্য পরিমাণ পনি দিতে হবে। এবার ভেজানো বীজের সাথে প্রতি কেজিতে ২ দশমিক ৩ থেকে ৫ গ্রাম কার্বেন্ডাজিং গ্রুপের ব্যাভিস্টিটিং ডিএফ ভালোভাবে মেশাতে হবে। তারপরে বীজগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে হালকা বাসাতে কিছুক্ষণ শুকিয়ে ক্ষেতে বপন করতে হয়। বীজ শোধনের কাজটি করতে হবে বপনের দু-তিন ঘন্টা আগে। তাহলে মিলবে কাঙ্ক্ষিত ফলন।