মুজিবনগর প্রতিনিধি: পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ১২ দিন পর মেহেরপুর গাংনী এলাকার চরমপন্থি সন্ত্রাসী পাঞ্জাব আলীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর গ্রামের একটি পরিত্যক্ত ইটভাটা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত শুক্রবার রাতের কোনো এক সময় তাকে শ্বাসরোধ ও আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
এ ঘটনার মধ্যদিয়ে এলাকার আরো এক মুকুটহীন সম্রাটের পতন হলো বলে মন্তব্য করেছেন এলাকার অনেকেই। চরমপন্থিদের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন মুজিবনগর থানার ওসি। পাঞ্জাব আলী গাংনী উপজেলার ছাতিয়ান গ্রামের হাওড়াপাড়ার গঞ্জের আলীর ছেলে। তার বিরুদ্ধে গাংনী ও দৌলতপুর থানায় ৪টি হত্যা মামলাসহ ৯টি মামলা রয়েছে।
জানা গেছে, মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর-কোমরপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে অবস্থিত জনৈক মশিউর রহমানের পরিত্যক্ত ইটভাটায় গতকাল সকালে লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন মাঠে কর্মরত কৃষকরা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তা উদ্ধার করে। নিহতের হাত-পা ও মুখ তিনটি গামছা দিয়ে বাঁধা ছিলো। মুখ, গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গভীর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে মুজিবনগর থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালমর্গে প্রেরণ করে। তবে কী কারণে কারা তাকে হত্যা করেছে তা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না পুলিশ। অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে পাঞ্জাব আলীর পরিবারের লোকজন মেহেরপুর হাসপাতালে ছুটে যান। দুপুর সাড়ে বারটার দিকে নিহতের ছোট ভাই রফছেদ আলী লাশ শনাক্ত করেন। মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী আব্দুস সালেক জানান, নিহতের ভাই লাশের পরিচয় নিশ্চিত করেন। পরে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকাল সন্ধ্যার আগে নিজ গ্রামে তার লাশ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মুজিবনগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। হত্যার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
পাঞ্জাবের স্ত্রী আহারন নেছা জানান, এলাকা থেকে আত্মগোপন করে ঢাকার নবীনগরের ভাড়ার বাসায় তারা সপরিবারে বসবাস করতেন। গত ৫ অক্টোবর রাতে কয়েকজন পুলিশের লোক পরিচয়ে পাঞ্জাবকে ধরে নিয়ে যায়। তবে তাদের কাউকে চিনতে পারেননি তিনি। পরদিন ঢাকার বিভিন্ন থানা ও গাংনী থানায় যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার কিংবা আটক করেনি বলে জানায় স্ব স্ব থানা কর্তৃপক্ষ। তখন থেকেই তাদের মনে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছিলো।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, পাঞ্জাব ছিলো গাংনীর ত্রাস বেআইনি চরমপন্থি সংগঠনের আঞ্চলিক নেতা। সে নিজেকে কখনও বড় ভাই আবার কখনও মেজ ভাই পরিচয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দায়িত্ব স্বীকার করতো। এছাড়াও সে বিভিন্ন ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে আসছিলো। তার বিরুদ্ধে বালিয়াঘাটের আদম আলী ও দেবীপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুর রহমান বেল্টু হত্যাসহ চারটি হত্যা মামলা, অস্ত্র ও বোমা বিস্ফোরণের দুটি এবং একটি চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে গাংনী থানায়। শুধু গাংনী এলাকায় নয় পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও মিরপুর এলাকায় আধিপত্য ছিলো পাঞ্জাবের। দৌলতপুর থানায় তার নামে অস্ত্র আইনে একটি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় তার আধিপত্য থাকলেও বামন্দী এলাকায় ছিলো মূল ঘাঁটি। কয়েক বছর আগে বামন্দীর উঠতি বয়সী কিছু যুবক নিয়ে সে নতুন করে বাহিনী গঠন করে। বোমা ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রদর্শন করে এলাকায় আধিপত্য ও চাঁদাবাজি শুরু করলে প্রশাসনের নজরে পড়ে। পুলিশ ও র্যাবের সাঁড়াশি অভিযানের ফলে কখনো আত্মগোপন আবার কখনো প্রকাশ্যেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো পাঞ্জাব। আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুর রহমান বেল্টু খুনের পর তার বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য মামলায় জড়িয়ে পড়ে। নিজেও আসামি হয়। তখন থেকে আবারো আত্মগোপনে চলে যায় পাঞ্জাব। এ হত্যাকাণ্ডে পাঞ্জাবের অংশগ্রহণের বিষয়টি পুলিশের কাছে স্পৃষ্ট হলে পাঞ্জাব সপরিবারে আত্মগোপন করে ঢাকায় এলাকার এক নেতার কাছে আশ্রয় নেয় বলে এলাকার গুঞ্জন ওঠে। সেখানে নিরাপদে থাকলেও তার ধরতে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অভিযান চলছিলো। এরই মধ্যে তার কয়েকজন সহযোগীকে হত্যা করা হয়। কয়েকজন ক্রসফায়ারে নিহত হয়। কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে হাজতবাসে যায়। পাঞ্জাবের পতনের মধ্যদিয়ে বামন্দী এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি নেমে এসেছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী কয়েকজন।
পাঞ্জাবের উত্থান: রাজমিস্ত্রি থেকে চরমপন্থি। ছাতিয়ান হাওড়াপাড়ার গঞ্জের আলীর ৪ ছেলের মধ্যে পাঞ্জাব দ্বিতীয়। সে রাজমিস্ত্রির কাজ করতো। বছর দশেক আগে সে চোরাচালানের পাশাপাশি ছিনতাই রাহাজানি ও ডাকাতি করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পরে চরমপন্থি সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়ে। বাবার মেজ ছেলে হওয়ায় এলাকায় সে মেজ ভাই নামে পরিচিত। গাংনীর বালিয়া ঘাটের চাঞ্চল্যকর আদম আলীকে হত্যার পর সে দায়িত্ব স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। এ থেকেই সে চলে আসে লাইমলাইটে। পরে কিছুদিন কারাবরণ শেষে ফিরে এসে আরো বেপরোয়া হয়ে নানা অপকর্ম করতে থাকে পাঞ্জাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানায়, এক সময় পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে এলাকা ত্যাগ করে দৌলতপুরের খলিসাকুণ্ডিতে আশ্রয় নেয়। সেখানে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক ব্যবসা। বামন্দী এলাকার কয়েকজন চরমপন্থির বিভিন্নভাবে পতনের মধ্যদিয়ে অঘোষিতভাবে তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় পাঞ্জাব। এক সময় বামন্দী এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিং হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে পাঞ্জাব। খুব অল্প টাকায় মানুষ হত্যার মত জঘন্য কাজ বেছে নেয়। পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে এমনই তথ্য মিলেছে।