স্টাফ রিপোর্টার: ‘সাঁইজির বাণীতে দীক্ষা পেয়েছি সত্যের পথে চলার। সমাজের সকল মানুষ যদি লালন সাঁইজির বাণী অনুসরণ করে, তাহলে সমাজে হানাহানি বন্ধ হবে, মানুষ আলোর পথ খুঁজে পাবে, সত্যের পথে চললে শাদা মনের মানুষ হবে। আর এভাবে আমরা প্রকৃত মানুষ খুঁজে পাবো। তাইতো সাঁইজি বলেছেন- এসব দেখি কানার হাট বাজার/বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা/আর এক কানা মন আমার/পন্ডিত কানা অহংকারে/.. সাধু কানা অন বিচারে/ আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে/ চেনে না সীমানা কার..।’ কথাগুলো বলছিলেন উপজেলার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়িতে আসা বাউল নিরঞ্জন সাধু।
বাউল সম্রাট মহামতি ফকির লালন সাঁইয়ের ১২৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি এখন দেশি-বিদেশি সাধু-ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত। সফেদ লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরিহিত হাজারো ভক্তের সমাগমে আখড়াবাড়ির চারপাশ শুধু শাদা আর শাদা। আখড়াবাড়ির মূল আঙিনা ও কালীগঙ্গা নদীর তীরে ভবের হাটে বসে ভজন-সাধনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন লালনভক্ত বাউলরা। হাতে একতারা, দোতারা, খঞ্জনি, তবলা আর হারমোনিয়াম নিয়ে গলা ছেড়ে গাইছেন আধ্যাত্মিক গান। গান শেষে সাধুগুরুরা তাদের শিষ্যদের গানের মর্মকথা ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছেন। খণ্ড-খণ্ড আসরে গান পরিবেশনের সময় দর্শক-জনতাও নেচে-গেয়ে গানের সাথে সাথে তাল দিচ্ছেন।
দলবল নিয়ে রাজবাড়ি জেলার কালুখালি উপজেলার বাংলাদেশ হাট থেকে এসেছেন লালন অনুসারী মোতালেব সাঁই। তিনি বলেন, ‘আমরা গৃহত্যাগী বাউল। সাঁইজির মানবতাবাদী আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে আমরা পথ চলি। বৈষম্য আর জাতপাতের নেতিবাচক চিন্তার বিরুদ্ধে আমরা মানব সেবার কথা প্রচার করি। এখানে সাঁইজির বাণী তর্পণ করে আমরা তার সান্নিধ্যের পরশ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।’
ফকির শরফুদ্দিন সাঁই বলেন, মহাগুরু ফকির লালন সাঁই জাত বিভেদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তাইতো তিনি বলেছেন, জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা। এ ভবের হাটে জাত ধর্মের কথা বলে মানব জাতিকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। অথচ জাত ধর্ম নিয়ে কেউ এখানে আসেনি। জাতের কথা বলে মূলত স্বার্থবাদী মানুষেরা বিভেদ তৈরি করছে।
গতকাল শুক্রবার শুরু হওয়া পাঁচদিনব্যাপি লালন স্মরণোত্সবের প্রথম দিন ভোর থেকে দেশের সব অঞ্চল তো বটেই বিদেশি সাধু-ভক্তরাও এসে প্রথমে কালীগঙ্গা নদীতে স্নান করেন। এরপর সাঁইজির মাজারে ভক্তি প্রদর্শন করেন। প্রতিবারের মতো এবারও সাধু-ভক্তরা বাল্যসেবা, পূণ্যসেবা ও অধিবাস চরম ভক্তির সাথে গ্রহণ করেন। দুপুরে আখড়াবাড়ির মূল আঙিনায় অবস্থানরত লালন ভক্তরা পূণ্যসেবা (দুপুরের খাবার) গ্রহণের আগে সারিবদ্ধভাবে সবাই এক কাতারে বসেন। কলাপাতায় দেয়া হয় শাদা ভাত, ইলিশ মাছ, সবজি, ডাল আর দই। চরম ভক্তির সাথে সবাই খাবার গ্রহণ করেন।
এদিকে লালন একাডেমির আয়োজনে লালনের মূল মাজারের সামনে নদীর তীরে বসেছে লালন মেলা। এতে স্থান পেয়েছে লালনের প্রতিকৃতি, একতারা, গলার মালা, হস্তশিল্পসহ হরেক রকম জিনিসপত্র। তবে কাঠের তৈরি লালনের আবক্ষ মূর্তি বিক্রি হচ্ছে বেশ। অবশ্য দুপুরের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের কিছুটা দুর্ভোগ পোয়াতে হয়।
এবার লালন স্মরণোত্সবে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। কুমারখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মহিবুল ইসলাম বলেন, তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পোশাকে ও শাদা পোশাকে নিরাপত্তা কর্মীরা নিয়োজিত আছেন। বিশৃঙ্খলা বা হাঙ্গামার কোনো সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, ১১৬ বছর বয়সে বাংলা ১২৯৭ সনের পয়লা কার্তিক ফকির লালন সাঁই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সাঁইজির তিরোধানের পর থেকে ভক্ত-শিষ্যবৃন্দ প্রতি বছর পয়লা কার্তিক ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে স্মরণোত্সব পালন করেন।