গাইবান্ধায় এমপির গুলিতে শিশু আহত : শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ
স্টাফ রিপোর্টার: গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের ছোঁড়া গুলিতে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় লোকজন। গতকাল ভোর পৌনে ছয়টায় সুন্দরগঞ্জ-বামনডাঙ্গা সড়কের ব্র্যাক মোড়ের গোপাল চরণ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। যদি এমপি দোষী হন অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। গুলিবিদ্ধ শিশু শাহাদাত হোসেন সৌরভ (৮) উপজেলার গোপালচরণ গ্রামের সাজু মিয়ার ছেলে ও গোপালচরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু সার্জারি বিভাগে চিকিত্সাধীন রয়েছে। কর্তব্যরত চিকিত্সক শুভ কুমার দাস জানান, সৌরভের ডান পায়ে একটি ও বাম পায়ে দুটি গুলির ক্ষত রয়েছে। মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের জাতীয় সংসদের সদস্য ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এ ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে গতকাল দুপুরে সুন্দরগঞ্জ পৌর মেয়র মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ করেন। পরে পুলিশ অবস্থানকারীদের সরিয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী জানান, এমপি লিটন ভোরে গাড়িতে করে নিজ বাড়ি বামনডাঙ্গা যাচ্ছিলেন। তিনি বামনডাঙ্গা-সুন্দরগঞ্জের সড়কের ব্র্যাক মোড়ের পশ্চিম পাশে ১০০ গজ দূরে গোপালচরণ এলাকায় পৌঁছে প্রাতঃভ্রমণকারী জনৈক এক মহিলাকে গাড়ির কাছে ডাকেন। কিন্তু মহিলা ভয়ে দৌড় দিয়ে চলে যান। পরে প্রাতঃভ্রমণকারী অপর এক ব্যক্তিকে ডেকে তার গাড়িতে উঠতে বলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তিও ভয়ে গাড়িতে না উঠে দৌড় দেন। এমপি ওই ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়লে রাস্তায় থাকা শিশু সৌরভের দু পায়ে গুলি লাগে।
শিশুটির চাচা শাজাহান আলী ওরফে সাজা মিয়া বলেন, ভোরে আমি ভাতিজাকে নিয়ে সড়কে হাঁটছিলাম। এ সময় এমপি গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন। এমপি গাড়ি থামিয়ে ইশারায় আমাকে ডাকেন। এক পর্যায়ে গাড়িতে উঠতে বলেন। কিন্তু এমপির গাড়ির ড্রাইভার ইশারা করে সরে যেতে বলেন। আমি দৌড় দিয়ে চলে গেলে এমপি পিস্তল বের করে গুলি ছোঁড়েন। সেই গুলি সৌরভের দু পায়ে লাগে। এরপর এমপি গাড়ি নিয়ে চলে যান। অবশ্য স্থানীয় কেউ কেউ বলেছেন, স্থানীয়রা জানান, এমপি লিটন গাড়িতে করে বামনডাঙ্গা থেকে সুন্দরগঞ্জ আসছিলেন। বামনডাঙ্গা-সুন্দরগঞ্জের ব্র্যাক মোড়ের পশ্চিম পাশের গোপালচরণ এলাকায় এমপির গাড়ি পৌঁছালে তার গাড়ির সামনে দৌঁড়ে এসে দাঁড়ায় সৌরভ। এ সময় এমপি তার কাছে থাকা পিস্তল বের করে সৌরভের দু পায়ে দুটি গুলি করে।
হাসপাতালে চিকিত্সাধীন শিশু সৌরভ কাঁদতে কাঁদতে বলে, প্রতিদিন ভোরে চাচার সাথে ওই সড়কে হাঁটি। সকালেও চাচার সঙ্গে হাঁটছিলাম। এমপি লিটন হঠাত ব্র্যাক মোড়ে গাড়ি থামান। তিনি গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে চাচাকে ইশারা করে ডাকেন। চাচা ভয়ে পালিয়ে যান। তখন এমপি গুলি করেন। গুলি লাগার পর আমি মাটিতে পড়ে যাই। দু পা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। আশপাশে তাকিয়ে দেখি চাচা নেই। রক্ত দেখে কাঁদতে থাকি। মাটি ধরে বার বার দাঁড়াতে চেষ্টা করি। পরে লোকজন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
শিশুর মা সেলিনা বেগম আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, সকালোত হামরা ঘুমোত অচিলাম। মানষের মুখে শুনি, সড়োকোত য্যায়া দেকি, ছ্যোলটা হামার মাটিত পড়ি আচে। হামার ছ্যোলটার এতো অক্ত (রক্ত) পড়লো। মুই এর বিচার চাও। ভোট দিয়্যা এমপি বানাছি, হামার ছ্যোলোক গুলি করার জন্যে? এমপি হোক আর যাই হোক, হামি ছ্যোলটেক গুলি মারার বিচার চাই।
সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) জিন্নাত আলী জানান, আহত শিশুকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রংপুর নিয়ে যাওয়ায় পথে বামনডাঙ্গা এলাকায় শিশুর বহনকরা অ্যাম্বুলেন্স আটক করে রাখে সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের লোকজন। এখবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান এবং শিশুকে রংপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি জানান, তিনি শুনেছেন এমপি লিটনের গুলিতে শিশুটি আহত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা ভয়ে পুলিশের কাছে মুখ খুলছেন না এবং এখন পর্যন্ত কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ করেনি। শিশুর পায়ে কার ছোঁড়া গুলি বিদ্ধ হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবদুল হাই মিলটন জানান, শিশুটিকে বহনকারী গাড়ি আটক করার কথা শুনে তিনি ঘটনাস্থলে যান। তবে কিভাবে শিশুর পায়ে গুলি লেগেছে এ বিষয়ে তিনিও মুখ খুলতে রাজি হননি। জেলা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেন, মামলা হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কার গুলিতে শিশুটি আহত হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাব তিনিও এড়িয়ে যান। এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের মোবাইলফোনে একাধিবার কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়ায় যায়। এর আগেও এমপি এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন। গত বছরের মে মাসে উপজেলার বামনডাঙ্গা কলেজ মাঠে সার্কাসের নামে অবৈধভাবে অশ্লীল নাচ গান চালানো হচ্ছিল। খবর পেয়ে তত্কালীন গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক এহছানে এলাহী পুলিশসহ ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠান। দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সার্কাস প্যান্ডেলের ভিতরে ঢুকে সার্কাস প্রদর্শন বন্ধ করে প্যান্ডেল ভাঙতে বলেন। কিন্তু এমপি লিটন ও তার লোকজন এসে দু ম্যাজিস্ট্রেটকে লাঞ্ছিত করেন।