জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার
স্টাফ রিপোর্টার: জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার চ্যাম্পিয়নস অব দ্যা আর্থ অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় তার সুদূরপ্রসারি কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ পলিসি লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে তাকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে তার এ পুরস্কার গ্রহণ করার কথা রয়েছে। এটি জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা। পরিবেশ বিষয়ে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এ সম্মাননা দেয়া হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ পুরস্কার প্রদানের কারণ ব্যাখ্যা করেছে পুরস্কার প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম স্বল্পোন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিনিয়োগ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্রে উত্কৃষ্ট বিনিয়োগ। প্রতিবেশগতভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার সরকারের সামগ্রিক পদক্ষেপের স্বীকৃতি দিতে এ পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনীত করা হয়েছে।
ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভাইরনমেন্টার প্রাইজ (ইউএনইপি)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঘনবসতিপূণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। সাইক্লোন, বন্যা ও খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দীর্ঘকাল যাবত এদেশের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের দুর্যোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক অচিম স্টেইনারের বরাত দিয়ে বলা হয়, বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনমূলক নীতিগত পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বাংলাদেশ তার উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কার্যক্রম থেকে শুরু করে বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় অনেক বেশি প্রস্তুত।
স্টেইনারের বরাত দিয়ে আরো বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনকে দেশে জাতীয় অগ্রাধিকার ইস্যু এবং একই সাথে এ বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে জোরালো ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নেতৃত্ব এবং দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কয়েক দিনের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনের অংশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির অগ্রগামী বাস্তবায়নকারী এবং অভিযোজন নীতির সপক্ষের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে শেখ হাসিনা অন্যদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। পুরস্কার সাইটেশনে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটিজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯’র উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম উন্নয়নশীল দেশ যেখানে এ ধরনের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে নিজস্ব তহবিল দ্বারা ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এ তহবিলে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
সরকার বর্তমানে বার্ষিক বাজেটের ৬-৭% (যা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সমান) জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করছে। এর ২৫% আসছে আন্তর্জাতিক সাহায্য দাতাদের কাছ থেকে। একটি ক্লাইমেট চেঞ্জ ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির কাজ চলছে যাতে জলবায়ু তহবিলের চাহিদা এবং সরবরাহ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো অতিরিক্ত চাহিদা হিসেবে নয় বরং সরকারের উন্নয়ন সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই প্রথমবার বিষয়টিকে স্থান দেয়া হয়েছে।
এছাড়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীতে বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে সাংবিধানিক নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। সংবিধানে জলাভূমি এবং বণ্যপ্রাণী রক্ষাকে প্রাধিকার দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার গৃহীত বন নীতিমালা আবহাওয়ার বেশ কিছু চরমভাবাপন্ন অবস্থার প্রতিকার হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবাযু পরিবর্তন সংক্রান্ত অভিযোজনে বস্তুগত এবং আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়াও, সরকার ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত ভবিষ্যত মোকাবেলায় জনগণকে প্রস্তুতি গ্রহণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এগুলোর মধ্যে বন্যাজনিত কারণে পানিবাহিত রোগ নিরাময়ে স্বাস্থ্যসেবা, আগাম সতর্কীকরণে কম্যুনিটি দল গঠন এবং পরিবেশ-বান্ধব কৃষি প্রযুক্তিতে উত্সাহ প্রদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকার দূষণমুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিশ্বের সর্ববৃহত্ সোলার হোম সিস্টেম গড়ে উঠেছে যা গ্রিড বহির্ভূত এলাকার ১০ শতাংশ জনগণের বিদ্যুত চাহিদা মেটাচ্ছে। এছাড়াও সরকার দেশের সবচেয়ে বৃহত গ্যাস নির্গমন উত্স ইটভাটা থেকে গ্যাস নির্গমন হ্রাসের পদক্ষেপ নিয়েছে। পরিবেশ, মানবস্বাস্থ্য রক্ষা এবং জীবিকায়নের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে জাহাজ-ভাঙা শিল্প যাতে উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশ বিনষ্ট না করতে পারে সেজন্য নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস এর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করতে পেরেছে। দেশটি ইতোমধ্যেই এর ক্ষতিকর প্রভাবের কুফল ভোগ করছে এবং প্রায়শই সবচেয়ে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই বিরূপ প্রভাবের প্রধান শিকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ১৯৯০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার বার্ষিক জিডিপি’র ১.৮% হারিয়েছে। তারপরও এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব নিরসন শুধু অর্থনীতির প্রশ্ন নয়, বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের পরিমাণ বৈশ্বিক গড় মাত্রার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে যা জীবন-জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং মানুষকে বাস্তুহারা করছে। অনুমান করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ৭ জনের মধ্যে একজন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুহারা হবেন এবং তারা শহরাঞ্চলের দিকে ধাবিত হবেন। দেশের শহরগুলো এখনই অধিক জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। জলবাযু পরিবর্তন মোকাবেলাকে দেশের উন্নয়ন অগ্রাধিকারের তালিকায় স্থান দেয়ায় আমি বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য উদাত্ত আহ্বান হচ্ছে এখনই পদক্ষেপ নিন। জলবায়ু পরিবর্তন যে ভবিষ্যতের কোনো সমস্যা নয়, এটা আমাদের জীবনকালেই ইতোমধ্যে ঘটে চলেছে।
প্রসঙ্গত, পলিসি, বিজ্ঞান, ব্যবসা এবং সুশীল সমাজ এই ৪টি ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়নস অব দ্যা আর্থ পুরস্কার দিয়ে থাকে জাতিসংঘ। পূর্ববর্তী পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের নেতা-নেত্রীসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মীগণ রয়েছেন যাদের নেতৃত্ব এবং কর্মকাণ্ড একটি টেকসই বিশ্ব সৃষ্টির এবং সবার জন্য মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য কাজ করেছে। ৪টি ক্যাটাগরিতে এ পর্যন্ত ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ পেলেন শেখ হাসিনা
