১০ বছর পর শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার বিচার শুরু

স্টাফ রিপোর্টার: সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুরে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মকবুল আহসানের আদালতে দু ঘণ্টা শুনানির পর দেশজুড়ে আলোচিত এ হত্যা মামলার চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু হয়েছে। মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির শীর্ষ নেতা হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জের বরখাস্ত হওয়া পৌর মেয়র জিকে গউছসহ ৩২ জনকে অভিযুক্ত করে বিচারকাজ শুরু হলো। এ সময় আদালত সিলেট সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া গ্রেফতারকৃত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ ৫ জনের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। চার্জগঠনের আগে অব্যাহতি আবেদনের শুনানি হয় বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তবে আদালত বরখাস্ত হওয়া কারান্তরীণ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর অসুস্থতার আবেদনটি আমলে নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার চিকিৎসা-সংক্রান্ত রিপোর্ট পাঠাতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হয়েছিলেন ১০ বছর আগে। আলোচিত এ মামলার তদন্ত শেষ করতে দীর্ঘদিন লেগেছে। এরই মধ্যে পুলিশ, ডিবি ও সিআইডি এ মামলার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করে। গত বছর সিআইডির করা অধিকতর তদন্ত রিপোর্টে বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ কয়েকজনকে নতুন করে চার্জশিটভুক্ত করা হয়। গেল বছর চার্জশিট দেয়ার পর চলতি বছরের জুন মাসে মামলাটি সিলেটের বিচারিক আদালত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ২১শে জুন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটির প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সব আসামি উপস্থিত না থাকায় ইতিমধ্যে ৯ দফা তারিখ পেছানো হয়। অবশেষে দশ দফা শুনানিকালে মামলার চার্জগঠন করা হয়। গতকাল ছিল মামলার চার্জগঠনের শুনানির দিন। এ কারণে ঢাকায় থাকা সব আসামিকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। গত মঙ্গলবার সর্বশেষ সিলেটে নিয়ে আসা হয় বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে। তার অনুপস্থিতির কারণেই বারবার এ মামলার চার্জগঠন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাচ্ছিলো। তাকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসার পর গতকাল সকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। এ সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আসামিদেন আনা হয় প্রিজন ভ্যানের একটি গাড়িতে। তাদের আদালতে আনার আগে গোটা আদালতপাড়ায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় একে একে সব আসামিকে নিয়ে আদালত এলাকায় প্রবেশ করে গাড়ি। বেলা ১১টার আগেই তাদের সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তোলা হয়। আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই একে একে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ ৫ জনের অব্যাহতির আবেদন করেন আইনজীবীরা। এর ফলে আদালতে অব্যাহতি আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা শুনানির পর আদালত অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর আরিফুল হক চৌধুরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আবেদনের শুনানি হয়। শুনানিকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য আরিফুল হক চৌধুরীকে বিদেশে নেয়ার কথা জানান আইনজীবীরা। আদালত তাদের আবেদন আমলে নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার স্বাস্থ্যগত রিপোর্ট আদালতকে অবহিত করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আলোচিত এ মামলার কারাবন্দি আসামি সিলেট সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্তকৃত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হবিগঞ্জ পৌরসভার সাময়িক বরখাস্তকৃত মেয়র জি কে গউছ, হরকাতুল জিহাদের প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান, দেলওয়ার হোসেন রিপন, বদরুল আলম, মিজানুর রহমান, হাফেজ নাঈম, মুহিবুল্লাহ, শরীফ শাহেদুল আলম, মুফতি মঈন উদ্দিন, আবদুল মাজেদ ভাট, শেখ মাওলানা আবদুল সালাম, শেখ ফরিদসহ জামিনে থাকা ৮ আসামি।

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের বৈদ্যের বাজারে এক জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। হামলায় নিহত হন কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী। এ ঘটনায় হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ খান হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। এ হত্যা মামলার ৩২ আসামির মধ্যে ১৪ জন কারাগারে, ৮ জন জামিনে এবং ১০ জন পলাতক রয়েছেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জগঠন পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। আদালত সূত্র জানিয়েছে, ২২ আসামির জামিনের প্রার্থনাও করা হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারক দীর্ঘ শুনানি শেষে এ আবেদনগুলোও খারিজ করে দেয়া হয়। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কিশোর কুমার কর জানিয়েছেন, মামলার আসামি আরিফুল হক চৌধুরী অসুস্থ থাকায় কয়েক দফা পিছিয়ে ছিল আলোচিত এ মামলার চার্জগঠন। মামলায় কারাবন্দি ও জামিনে থাকা ২২ আসামির উপস্থিতিতে মামলার চার্জগঠন হয়। এ ছাড়া পলাতক ১০ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। আগামী তারিখের মধ্যে তাদের আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আরিফুল হকের পক্ষে দাখিলকৃত চিকিৎসার জন্য আবেদন মঞ্জুর করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মেডিক্যাল রিপোর্ট দাখিল করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আরিফুল হকের পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী মোহাম্মদ লালা। তিনি বলেন, আমরা আদালতের কাছে তার অব্যাহতির আবেদনের পাশাপাশি অসুস্থতার আবেদন করি। আদালত তার অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। তবে, তার স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রকট। বিষয়টি আদালতকে জানানোর পর আদালত কারা কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে, আরিফের কারণেই বারবার পিছিয়ে গিয়েছিল চার্জগঠন প্রক্রিয়া। গত ৬ই সেপ্টেম্বর ছিল কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জগঠনের সর্বশেষ তারিখ। তবে আসামি কারাবন্দি আরিফুল হক চৌধুরী অসুস্থ থাকায় এবং তাকে আদালতে হাজির না করায় ওই দিন চার্জগঠন হয়নি। এর আগে গত ২১ জুন, ৬, ১৪ ও ২৩ জুলাই এবং ৩, ১০, ১৮, ২৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর আলোচিত এ হত্যা মামলার চার্জগঠনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিলো। কিন্তু সব আসামি আদালতে হাজির করতে না পারায় চার্জগঠনের তারিখ পিছিয়ে যায়। সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানিয়েছেন, বারবার তারিখ পেছানোর পর সব আসামি উপস্থিত থাকায় চার্জগঠন করা হয়েছে। আদালত আসামিপক্ষের ও রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শুনে চার্জগঠন করেন। এর ফলে আলোচিত এ হত্যা মামলার ন্যায়বিচার দ্রুততম সময়ে পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি। হবিগঞ্জ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসাইন জানিয়েছেন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ত্রুততম সময়ের মধ্যে এ মামলার বিচার শেষ হওয়ার কথা। ৩ মাসের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিচারক ইচ্ছা করলে কিছুটা সময় বাড়াতে পারেন। তবে, তিনি আশা করেন, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাদীপক্ষ ন্যায়বিচার পাবে।

আদালত প্রাঙ্গণে ভিড়: সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জগঠন উপলক্ষে দীর্ঘ ৮ মাস পর সিলেটের আদালতে আসেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া গ্রেপ্তারকৃত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে। এ কারণে আদালত এলাকায় ভিড় করেন লোকজন। এর মধ্যে অধিকসংখ্যক উপস্থিতির মধ্যে ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সিলেট জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতা দিলদার হোসেন সেলিম, অ্যাডভোকেট নুরুল হক, অ্যাডভোকেট আবদুল গফ্‌ফার, বিএনপি নেতা নাসিম হোসাইন, জেলা বিএনপি নেতা আলী আহমদ, বিএনপি নেতা ও সিটি কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম, মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জিয়াউল গনি আরেফিন জিল্লুরসহ সিনিয়র নেতারা আদালত এলাকায় উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি সিলেট সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আরিফুল হক চৌধুরীকে সকাল পৌনে ১১টায় অ্যাম্বুলেন্স করে যখন আদালতে নিয়ে আসা হয়, তখন তাকে একনজর দেখতে ভিড় করেন সবাই। এ সময় কারা সদস্যরা হুইল চেয়ারসহ আরিফুল হক চৌধুরীকে গাড়ি থেকে নামান। এ সময় তাকে দেখে স্লোগান দেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তাদের স্লোগানের সময় হুইল চেয়ারে বসে থাকা আরিফুল হক চৌধুরী কান্নায় ভেঙে পড়েন। অস্রুভেজা চোখে তিনি হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের অভিবাদন জানান। পরে কারা সদস্যরা তাকে হুইল চেয়ারে করেই আদালতে নিয়ে যান। শুনানিকালে আরিফ হুইল চেয়ারেই বসে থাকেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা তারা আদালতে ছিলেন। এ সময়ও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কমেনি। আদালত থেকে বের করে নেয়ার সময়ও বিষণ্ন ছিলেন আরিফ। এ সময়ও নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা চালান। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে তাকে ফের কারাগারে নিয়ে যান।