বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রম করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখনও আমরা শতভাগ সাক্ষরতার মাইলফলক অর্জন করতে পারিনি। গত মঙ্গলবার ছিলো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এ দিবসে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার কতো তা নিয়ে বিতর্ক উঠতে দেখা যায়। এ বিতর্ক সত্যি দুঃখজনক। এতে বোঝা যায়, প্রকৃতপক্ষে নিরক্ষর লোক কতো সে তথ্য কারও কাছে নেই। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিলো যে, দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭১ ভাগ। তখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন বলেছিলেন, বিগত সাড়ে চার বছরে মহাজোট সরকারের আমলে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯ ভাগ। কিন্তু গত রোববার একই মন্ত্রণালয়ে সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বর্তমান মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান দেশে সাক্ষরতার হার ৬১ শতাংশ বলে জানিয়েছেন। আবার গত বছর তিনি বলেছিলেন ৬৫ শতাংশ। সাক্ষরতার এ হার নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন।
নিরক্ষরতা দূর করার জন্য দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। যদি সাক্ষরতার হার উন্নত না হয়, তা হলে বোঝা যাবে এসব সংস্থার কর্মসূচির মধ্যে গলদ আছে। এ বিষয়ে নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য দেশে প্রকৃতপক্ষে কতোজন নিরক্ষর সর্বাগ্রে তার সঠিক হিসেব থাকা দরকার। এবার সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘সাক্ষরতা আর দক্ষতা, টেকসই সমাজের মূলকথা’। আসলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যে জাতি যতো বেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততো বেশি উন্নত। তাই নিরক্ষর লোকদের জীবনমান উন্নয়নে স্বাক্ষর ও জীবন চলার পথে কাজে লাগে এমন যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। সাক্ষরতার হার বাড়াইতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে কার্যকর করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন ২০১৪ নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তারপরও এক্ষেত্রে আমরা কতোটা সফল হচ্ছি তা প্রশ্নসাপেক্ষ বটে। গ্রামে-গঞ্জে নৈশবিদ্যালয়ের প্রচলন আজ তেমন একটা চোখে পড়ে না। নিরক্ষর মধ্যবয়স্ক এমনকি বয়স্ক লোকদের বাদ দিয়ে তো দেশে শতভাগ সাক্ষরতার হার অর্জন করা সম্ভব না। এ ব্যাপারে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো জরুরি। তারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বা অল্প বেতনে সারাদেশের নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান প্রদানে ব্রত গ্রহণ করতে পারে। তাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারের তরফ হতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সাফল্য অর্জনকে আমরা খাটো করে দেখতে চাই না। শতভাগ স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে সরকার চালু করেছে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম। শিক্ষক নিয়োগ, নতুন বিদ্যালয় স্থাপনসহ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তাহলে শতভাগ সাক্ষরতার স্বপ্ন পূরণ হবে না কেন? প্রথমতো এজন্য শিক্ষা বা সাক্ষরতার হার নিয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নেয়া চলবে না। বাস্তবতা উপলব্ধি করে ও বর্তমান কর্মসূচির ভুল-ভ্রান্তি নিরুপণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আমাদের। নিরক্ষরতা কিভাবে আমাদের পেছনের দিকে টানছে তা উপলব্ধি করার জন্য একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। যেমন-ওয়ার্ল্ড লিটারেসি ফাউন্ডেশনের নিরক্ষরতার অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরক্ষর ব্যক্তিরা সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিদের চেয়ে ৩০ হতে ৪২ শতাংশ কম আয় করেন। এ হিসেবে বাংলাদেশে যদি এখনো ১৫ হতে ৪৫ বছর বয়সী ৩ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ নিরক্ষর থাকেন (সরকারি হিসাব মতে), তা হলে আমাদের যে আর্থিক ও সামাজিক মূল্য দিতে হচ্ছে তার পরিমাণ ১০২ কোটি ডলার বা প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশকে যদি মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নত দেশে পরিণত করতে হয়, তাহলে নিরক্ষতার সমস্যা দূরীকরণে সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে হতে হবে দায়িত্বশীল।