টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করে ৮ম জাতীয় পে-স্কেল মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
স্টাফ রিপোর্টার: টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করে অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে সর্বোচ্চ বেতন ৭৮ হাজার টাকা (নির্ধারিত) ও সর্বনিম্ন ৮২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মতো ২০টি গ্রেড বহাল রাখা হয়েছে। টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেয়া হলেও নতুন বেতন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বাংলা নববর্ষ ভাতা। মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে এই ভাতা পাবেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে নুতন পে-স্কেলের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের জানান, নতুন পে-স্কেলে ইনক্রিমেন্ট পদ্ধতি বাতিল করে প্রতি বছর পয়লা জুলাইয়ে শতাংশ হারে বেতন বাড়ানোর বিধান রাখা হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন বৃদ্ধির বিধান থাকায় আগামীতে কোনো স্থায়ী পে-কমিশন গঠন করা হবে না।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও জানান, নতুন স্কেলে পেনশনের হার নির্ধারণ করা হয়েছে মূল বেতনের ৯০ শতাংশ, যা আগে ছিলো ৮০ শতাংশ হারে। আর প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত কোনো শ্রেণি থাকছে না। শ্রেণি প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী নিজেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দেবেন। নতুন পে-স্কেল কার্যকর হবে পয়লা জুলাই থেকে। চলতি অর্থবছরে দেয়া হবে মূল বেতন। আর ২০১৬ সালের জুলাই থেকে সব ধরনের ভাতা কার্যকর হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে এই বেতন বাস্তবায়ন করতে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে ১৫ হাজার ৯০৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরে বেতন ও ভাতাসহ কার্যকর করতে বাড়তি ২৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, নতুন পে-স্কেলে পয়লা জুলাই থেকে বেতন পাবেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও। এক্ষেত্রে কোন কোন প্রতিষ্ঠান নতুন পে-স্কেল পাওয়ার যোগ্য তা পর্যালোচনা করা হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা এবং বেতন বৈষম্য দূর করতে মন্ত্রিসভা কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওই কমিটি প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে সরকারকে একটি রিপোর্ট প্রদান করবে। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বেতন বাড়বে শতাংশ হারে: নতুন বেতন কাঠামোতে সরকারি চাকরিজীবীদের ইনক্রিমেন্ট নির্ধারিত হার থাকছে না। এখন থেকে গ্রেড-দুইয়ের ইনক্রিমেন্ট প্রতি বছর দেয়া হবে তিন দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। গ্রেড-তিন এবং গ্রেড-চারের ইনক্রিমেন্ট হবে চার শতাংশ হারে, গ্রেড-পাঁচের ইনক্রিমেন্ট হবে চার দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে, গ্রেড-ছয় থেকে ২০ পর্যন্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ইনক্রিমেন্ট হবে পাঁচ শতাংশ হারে।
বেতন গ্রেড থাকছে ২০টি: জাতীয় পে-স্কেলে ২০টি গ্রেড রাখা হয়েছে। এই গ্রেডের বাইরে থাকছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও তিন বাহিনীর প্রধান। এক্ষেত্রে বেতন হবে ৮৬ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। নির্ধারিত গ্রেডের বাইরে থাকবেন সিনিয়র সচিব ও একই পদমর্যাদার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। এদের বেতন ৮২ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। নতুন বেতন স্কেলে গ্রেড-একে সচিবের বেতন রাখা হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা (নির্ধারণ), গ্রেড-দুই ৬৬ হাজার টাকা, গ্রেড-তিন ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-চার ৫০ হাজার টাকা, গ্রেড-পাঁচ ৪৩ হাজার টাকা, গ্রেড-ছয় ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-সাত ২৯ হাজার টাকা, গ্রেড-আট ২৩ হাজার টাকা, গ্রেড-নয় ২২ হাজার টাকা, গ্রেড-দশ ১৬ হাজার টাকা, গ্রেড-এগারো ১২ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-বারো ১১ হাজার ৩০০ টাকা, গ্রেড-তেরো ১১ হাজার টাকা, গ্রেড-চৌদ্দ ১০ হাজার ২০০ টাকা, গ্রেড-পনেরো ৯ হাজার ৭০০ টাকা, গ্রেড-ষোলো ৯ হাজার ৩০০ টাকা, গ্রেড-সতেরো ৯ হাজার টাকা, গ্রেড-আঠারো ৮ হাজার ৮০০ টাকা, গ্রেড-উনিশ ৮ হাজার ৫০০ এবং গ্রেড-বিশ ৮ হাজার ২৫০ টাকা।
টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড: দীর্ঘদিনে এই সুবিধা নতুন বেতন স্কেলে বহাল রাখতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দাবির মুখেও শেষ পর্যন্ত এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড উভয় প্রথা বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়, টাইমস্কেল কেউ পায়, কেউ পায় না। সিলেকশন গ্রেড কর্মকর্তারা বেশি পেয়ে থাকেন। এই দু সুবিধা বাতিল করে সবাই যাতে পায় সে সুবিধা রাখা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় বেতন কাঠামোর রিপোর্টে।
নববর্ষের ভাতা: নতুন বেতন স্কেলে বাংলা নববর্ষের ভাতা চালু করা হয়েছে। মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে নববর্ষের ভাতা পাবেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অন্যান্য বিশেষ ভাতা হবে নির্ধারিত হারে। আগে ছিল শতাংশ হারে। তবে বাড়িভাড়া ভাতা হবে শতাংশ হারেই। নতুন পদ্ধতিতে সব ধরনের ভাতা আগের তুলনায় বেশি হবে। আর এই নতুন বোনাস ও ভাতা কার্যকর হবে আগামী বছরের পহেলা জুলাই থেকে।
কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শ্রেণি বিলুপ্ত: ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ও চর্তুথ শ্রেণীর কর্মচারী এই প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এখন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরিচয় হবে গ্রেড দিয়ে। ক্লাস ওয়ান অফিসার শব্দ বলতে কিছু থাকবে না। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর পরিচয় হবে ২০ গ্রেডের কর্মচারী হিসেবে। তৃতীয় ও চর্তুথ শ্রেণীর কর্মচারী বলে মানসিক দুর্বলতা তৈরি হয় তা অবসান করতে শ্রেণী প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। তবে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মাধ্যমে সরকারি কাগজপত্র সত্যায়িত করার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করা হবে।
পেনশনের হার বৃদ্ধি: নতুন বেতন কাঠামোতে অবসরে যাওয়ার সময় মূল বেতনের ৯০ শতাংশ হারে পেনশন নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে এই হার ছিল মূল বেতনের ৮০ শতাংশ। নতুন পে-স্কেলে পেনশনের হার বাড়ানো হয়েছে ১০ শতাংশ।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও পে-স্কেলে বেতন পাবেন: নতুন পে-স্কেলে বেতন পাবেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও। পহেলা জুলাই থেকে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এই বেতন পাবেন। তবে এক্ষেত্রে একটি পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা হবে মূলত কোন কোন প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়মনীতি অনুসরণ করছে। তবে নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রস্তাব পর্যালোচনা করবে মন্ত্রিসভার কমিটি: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন বেতন কাঠামোর ব্যাপারে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাব স্বল্প সময়ে বিবেচনা করা সম্ভব নয়। ফলে এসব প্রস্তাব বিবেচনা করতে বেতন বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওই কমিটি পর্যালোচনা করে সরকারকে রিপোর্ট প্রদান করবে। তবে বর্তমান বহাল থাকা কোনো সুযোগ-সুবিধা খর্ব করবে না কমিটি। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বিজ্ঞানীদের জন্য বিশেষ সুবিধা: বিজ্ঞানীদের বেতন কাঠামো একই হবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানে বা গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য বিজ্ঞানীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে। সেটি হবে অপরিসীম।
সশস্ত্র বাহিনীর জন্য পৃথক বেতন কাঠামো: মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য পৃথক বেতন কাঠামোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তার বেতন হবে ৮৬ হাজার টাকা। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তার বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৮২ হাজার টাকা। আর মেজর জেনারেলের বেতন নির্ধারণ করা হয় ৭৮ হাজার টাকা। সর্বনিু সৈনিক পদের বেতন কাঠামো হচ্ছে ১৭ হাজার টাকা। তবে বর্তমান সেনাবাহিনীর প্রধানের পদবি হচ্ছে জেনারেল। নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার। তবে তিন বাহিনীর প্রধানের বেতন সমান ৮৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আগামীতে নৌ ও বিমান বাহিনীর পদমর্যাদা উন্নীত করে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদমর্যাদার সমান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে।
মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক শেষে ব্রিফিং: বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, টাইমস্কেলে যে বেতন বাড়ত নতুন পদ্ধতিতে আরও বেশি বাড়বে। এতে লাভবান হবে সরকারি চাকরিজীবীরা। তিনি আরও বলেন, মহার্ঘ ভাতা ২০ শতাংশ বাতিল হবে। ডিএ পাওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, নববর্ষের বোনাস গ্রামীণ উৎসাহ অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। কারণ বাংলা নববর্ষে অধিকাংশ গ্রামীণ জিনিস বিক্রি হয়। তিনি আরও বলেন, নতুন বেতন বাস্তবায়ন করতে সরকারের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমাদের রাজস্ব আয় বাড়ানো হবে।
উল্লেখ্য, জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে। এরপর এ কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। সেখানে আবার পর্যালোচনা করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য তা উপস্থাপন করা হয়।
৮ম বেতন কাঠামোতে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করায় স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন আলমডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাটবোয়ালিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াকুব আলি মাস্টার।