মহেশপুর প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের মহেশপুরে মাতৃহারা শিশুদের কান্না থামছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ একটি টিম ঘটনার তদন্ত করছে। চার প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ও ৬ জন অসুস্থ হওয়ার ঘটনার সত্যতা মিলেছে। ঝিনাইদহের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ তদন্তদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। বর্তমানে বেরিয়ে আসছে চিকিৎসার নামে মানুষ হত্যার রহস্য। এদিকে মহেশপুর উপজেলার সীমান্ত সংলগ্ন ভৈরবা বাজারের জননী ও শৈলকুপা উপজেলা শহরের আয়েশা ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অপারেশনের সাথে জড়িত চারজন ডাক্তার ও দু ক্লিনিক মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
তদন্তদলের প্রধান সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম জানান, সিজার অপারেশনের পরে ব্রেইনে ইনফেকশন হয়ে রোগীরা মারা গেছেন। মুমূর্ষু অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হবে। তদন্তদলের সাথে ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের সভাপতি মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) ডা. ইমদাদুল হক ও সার্জারি কনসালটেন্ট ডা. জাহিদুর রহমান সাথে ছিলেন। তদন্তদল মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তার দফতরে মৃত্যুবরণ করা প্রসূতি মায়েদের স্বজনদের বক্তব্য গ্রহণ করেন। এ সময় স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং সিজার ও অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের সাথে জড়িত ডাক্তার, নার্স ও ক্লিনিক মালিকদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বিচার দাবি করেন। জীবননগর উপজেলার বারান্দি গ্রামের ইউসুফ আলীর স্ত্রী ছালেহা খাতুন (২৫) সিজার করার পরে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাবা মহেশপুর উপজেলার গাড়াপোতা গ্রামের আলী মুহাম্মদ বলেন, ৪০ হাজার টাকা খরচ করেও মেয়েকে বাঁচানো যায়নি। তার ভাষায়, ডাক্তার গোলাম রহমান ও ডাক্তার আসাদুজ্জামান এবং ক্লিনিক মালিক খোকনের ফাঁসি দিতে হবে। তদন্তদল মহেশপুর উপজেলা সীমান্ত সংলগ্ন ভৈরবা বাজারের জননী ক্লিনিক পরিদর্শন করে এবং অপারেশনের পর মৃত্যুবরণকারী বিথি ও রুপার বাড়িতে যায়। সেখানে এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সৃষ্টি হয়। মাতৃহারা শিশুদের কান্নায় তদন্তদলের চোখে পানি এসে যায়।
এ সময় তদন্তদলের সদস্য ডা. ইমদাদুল হক আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, গ্রামে গ্রামে গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক ও প্রাইভেট হাসপাতাল বন্ধ করতে হবে। এসব ক্লিনিকে ডাক্তারদের না আসার জন্য পরামর্শ দেন তিনি। একই কথা বলেন অপর সদস্য ডা. জাহিদুর রহমান।
ভৈরবা কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল আলম বলেন, অবৈধভাবে পরিচালিত এসব কিনিকের সাথে প্রভাবশালী মহল জড়িত রয়েছেন। তিনি তাদের বিচার দাবি করেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলেন, যততত্র ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গজিয়ে ওঠার পেছনে সিভিল সার্জন দফতরের একটি চক্র জড়িত রয়েছে। মৃত রুপার বাবা দিনমজুর আবুবক্কর কান্নাজড়িত কন্ঠে ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় বলেন, মাতৃহারা শিশুর মুখে আহার তুলে দেয়ার মতো ক্ষমতা নেই তার। একই কথা বলেন রুপার মা তহুরা খাতুন। গ্রামের আলাতাফ হোসেন বলেন, দালালচক্রের পাল্লায় পড়ে এলাকার মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। এলাকাটি পরিদর্শনকালে জানা যায়, সিজার ও অ্যাপেন্ডিসাইটস অপারেশন করে মুত্যৃর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন আরো অন্তত ৬ প্রসূতি ও এক যুবক। তারা ঢাকা খুলনা ও যশোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এলাকাবাসী জানান, এ পর্যন্ত অন্তত ৮/৯ জন বিভিন্ন সময়ে মারা গেছে।
সূত্র জানায়, জননী ক্লিনিক নামের কসাইখানার সাথে জড়িত মহেশপুর উপজেলার মান্দারবাড়িয়া সাবসেন্টারের ডাক্তার আসাদুজ্জামান ৩৩তম বিসিএস। তিনি এলাকায় যোগদান করেছেন মাত্র কয়েক মাস। তদন্তদল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং রোগী মারা যাওয়ার ঘটনা স্বীকার করেছেন তিনি। সূত্রমতে অন্য দু ডাক্তার গোলাম রহমান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত ডাক্তার আশরাফুল হক দিপু তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হননি। মহেশপুর থানার ওসি এ রিপোর্ট লেখার সময় জানিয়েছেন ওই ক্লিনিকের মালিক মো. মোমিনুর রহমান ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন। তাকে পাওয়া মাত্র গ্রেফতার করা হবে। এছাড়াও শৈলকুপায় আয়েশা ক্লিনিকে গত ২৮ আগস্ট অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করার পরে মারা যায় শেখপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে হিটলার হোসেন (১৮) নামের এক যুবক। এর আগে একই ক্লিনিকে মারা যায় উপজেলার ফাজিলপুর গ্রামের আব্দুল হালিমের প্রসূতি কন্যা রাফেজা খাতুন। শৈলকুপা থানার ওসি হাশেম খান জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে দুটি হত্যা মামলা ওই ক্লিনিকের মালিকসহ সংশিষ্টদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ডাক্তার আসলাম হিটলারের দেহে অস্ত্রোপচার করেন এবং অজ্ঞান চিকিৎসক ছিলেন ডা. রেজাউল ইসলাম। সূত্র মতে ডা. রেজাউলের ভুল চিকিৎসায় শিশু মৃত্যুবরণের ঘটনায় ৮ বছর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। তিনি চলতি সালের মে মাসে চাকরি ফিরে পান এবং হরিনাকুণ্ডু স্বাস্থ্য কমপেক্সে যোগদান করেন। বর্তমানে ডেপুটেশনে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে কর্মরত। সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার শৈলকুপার আয়েশা ক্লিনিকে রোগী মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে। তদন্তকমিটি ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন বলেও জানা গেছে। এদিকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা হওয়ায় অনেক ডাক্তার ক্লিনিকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তদন্ত ছাড়াই হত্যামামলা রেকর্ড হওয়ায় জেলায় কর্মরত ডাক্তারদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে।