অনাচার হলে অভিযোগেরও জায়গা নেই বলে মন্তব্য করে মোস্তফা জব্বার বললেন
স্টাফ রিপোর্টার: আমরা থ্রিজি সেবা পাচ্ছি না। প্যাকেজের নামে যা হচ্ছে তা রীতিমতো মহাঅন্যায়। টুজির যুগে ইন্টারনেটে তেমন গতি ছিলো না। তখন বলা হচ্ছিলো- থ্রিজি আসলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। পুরো বদলে যাবে দেশ- বদলে যাবে ইন্টারনেটের গতি। তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সবাই থ্রিজির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন। অনেক বাধা বিপত্তির পর আসে সেই থ্রিজি। শুরুতে নানা ধাক্কা খেলেও সামলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করে। কেমন যেন গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে গেলো সাধারণ মানুষ। একটি ফাইল খুলতেই কেটে নিচ্ছে কয়েক মেগাবাইট। আবার বন্ধ করে রাখলেও কমে যাচ্ছে! বিভিন্ন রকমের প্যাকেজের চক্করে পড়ে কাহিল অবস্থা। এর মধ্যে বলা হচ্ছে- ফোরজির যুগে শিগগিরই প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। টু থেকে থ্রি, এরপর ফোর- কিন্তু মানুষ কি পাচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত সেবা? এমনকি যার কোনো প্রয়োজনই নেই তার হাতে ইন্টারনেট তুলে দিয়ে কেটে নেয়া হচ্ছে টাকা। আর একবার এই চক্করের মধ্যে ঢুকে পড়লে বের হওয়াও যাচ্ছে না। দিনের পর দিন শুধু টাকাই চলে যাচ্ছে।
মোবাইলফোন অপারেটররা বলছে, থ্রিজির যুগে প্রবেশের পর ইন্টারনেটে গতি বেড়েছে কয়েকগুণ। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে। আর না বোঝার কারণে মেগাবাইট কমে যাচ্ছে। কারণ স্মার্ট ফোনে অনেক অ্যাপস থাকে যা ইন্টারনেট চালু হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট নিতে থাকে। ফলে গ্রাহক বুঝতে পারে না তার মেগাবাইট কীভাবে কমে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারনেট হচ্ছে সভ্যতার মেরুদণ্ড। তাই ইন্টারনেট ছাড়া সভ্যতা কল্পনা করাও কঠিন। ফলে জনগণ যে টাকা দিচ্ছে তার যেন সঠিক সেবা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষকে বোকা বানিয়ে ইন্টারনেটের নামে মোবাইল থেকে যেন টাকা লুট হয়ে না যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, হাজার রকমের প্যাকেজের নামে জোচ্চুরি করে টাকা নেয়া হচ্ছে। এতো প্যাকেজ দেয়া হয় শুধুমাত্র মানুষকে বোকা বানাতে। সারাবিশ্বে এটাই স্বীকৃত। এখন গ্রামীণফোনের ২৮-২৯ প্যাকেজ চলছে। বাংলালিংক, রবিসহ অন্যদেরও তাই। ফলে এসব বিষয়ে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। আমরা এখন জিম্মি। তবে একটা কথাই বলবো, স্বল্প সময়ে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে এমন স্বপ্ন যেন দেখানো না হয়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আহসান জামিল বলেন, মোবাইলফোন থেকে কথা বলার সময় টাকা কেটে নিলেও আমরা ধরতে পারি। বুঝতে পারি কতো টাকা কাটা গেলো। কিন্তু ইন্টারনেটে তো কিছুই বোঝা যায় না। বেঁচে থাকা মেগাবাইট পরের প্যাকেজের সাথে যোগ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মোবাইলে ব্যালান্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নতুন করে রিচার্জ করলে আগের ব্যালেন্স যোগ হয়। কিন্তু ডাটা বেঁচে থাকলে তা আর পরের প্যাকেজের সাথে যোগ হয় না। এটা পরের প্যাকেজে যোগ করার দাবি তার।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি মোস্তফা জব্বার বলেন, ইন্টারনেট হলো সভ্যতার মেরুদণ্ড। সারাবিশ্বে এখন ৩২০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের এ অঞ্চলে ব্যবহারকারী তুলনামূলক কম। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেটের গ্রাহক ছিলো মাত্র ১২ লাখ। আর এখন ৫ কোটিরও বেশি। এর জন্য অবশ্যই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কৃতিত্ব পেতে পারেন। কিন্তু কথা হচ্ছে- আমাদের তো এখন উপজেলা পর্যায়ে থ্রিজি থাকার কথা। আসলে বাস্তবতা হলো- জেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে কোনোমতে। ফলে আমরা থ্রিজি সেবা পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, আবার প্যাকেজের নামে যা হচ্ছে সেটা রীতিমতো মহা অন্যায়। কারণ আমার প্যাকেজ কখন শেষ হচ্ছে আমি জানি না। এরপর কিলোবাইট হিসেবে টাকা কাটতে শুরু করে। কিছুদিন পর দেখা যায় যতো টাকাই থাকুক ব্যালেন্স শূন্য। এ ধরনের অনাচার পৃথিবীর কোনো দেশে হয় না। আর এখানে অনাচার হলে অভিযোগ করারও জয়গা নেই। তাই বলি এভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে না। এর জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দরকার। নূন্যতম গতি ১ এমবিপিএস না হলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট হয় না।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। ডাক, ইমেল ও ফোন; ওয়েবসাইট এবং শর্ট কোডে অভিযোগ নেয়া হচ্ছে। গত তিন মাসে বিটিআরসিতে ১৬৭টি অভিযোগ এসেছে। এর অধিকাংশই ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে মেগাবাইট কেটে নেয়ার অভিযোগ। বিটিআরসির সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ৫ কোটি ৭ লাখ। গত বুধবার বিটিআরসি এই হিসাব প্রকাশ করে। এর মধ্যে ৪ কোটি ৯২ লাখই মোবাইলফোনের গ্রাহক। আর ১২ লাখ গ্রাহক আইএসপি ও পিএসটিএন অপারেটরের। ওয়াইম্যাক্সের গ্রাহক মাত্র ১৭ হাজার।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের উপদেষ্টা আখতারুজ্জামান মঞ্জু বলেন, সংখ্যায় মোবাইলফোন অপারেটরদের গ্রাহক বিরাট। কিন্তু আমরা একটি ব্যাংকের করপোরেট অফিসে কানেকশন দেই। সেখানে অন্তত ১ হাজার পিসিতে সংযোগ দিতে হয়। সেখানে কি পরিমাণ ডাটা ব্যবহার হয়? ওরা ক’টা ব্যাংকে বা অফিসে এমন সংযোগ দিতে পারছে। মোবাইল অপারেটরদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, নানা ছলে-বলে ওরা মোবাইলফোন ব্যবহারকারীকে ইন্টারনেট সংযোগ দিচ্ছে। এরপর থেকে শুধু বিল কাটতেই থাকে। গ্রামের একজন কৃষক বা একজন ছাত্র বুঝতে পারে না কীভাবে তার টাকা কাটা যাচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকদের বোকা বানিয়ে টাকা কামিয়ে নেয়াই ওদের আসল লক্ষ্য।
২০১৩ সালে নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেয়া হয়। গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল বরাদ্দ পায় থ্রিজি স্পেকট্রাম। ২ হাজার ১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৪০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বরাদ্দের নিলামে গ্রামীণফোন নেয় ১০ মেগাহার্টজ। বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল প্রত্যেকে নেয় ৫ মেগাহার্টজ করে। আগেই রাষ্ট্রীয় অপারেটর টেলিটককে দেয়া হয় ১০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম। ইন্টারনেট নিয়ে অভিযোগের ব্যাপারে মোবাইলফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) টিআই নুরুল কবির বলেন, ইন্টারনেট এখন দৈনন্দিন জীবনের সাথে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর জাতিসংঘ তো ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম করেছে।
তিনি বলেন, মোবাইলফোন কোম্পানিগুলো বিপুল টাকা খরচ করে কানেকটিভিটি করেছে। সার্ভিস এবং বিলিং নিয়েও তারা কাজ করছে। কোয়ালিটি অব সার্ভিস তারা নিশ্চিত করতে চায়। আসলে এটি সরকার-অপারেটর-গ্রাহক সবার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। এখানে উইন উইন সিচুয়েশন দরকার। দরকার সরকারের প্রণোদনা। অথচ সরকার এখান থেকে যতো বেশি পারছে চাপ দিয়ে টাকা নিচ্ছে।