নিধন ছেড়ে পাখি রক্ষায় শপথ : গাংনীর চেংগাড়া গ্রাম এখন কলকাকলিতে মুখর

শপথ ভাঙলেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি

 

মাজেদুল হক মানিক: আমরা পাখি শিকার করবো না, অতিথির মতোই সম্মান করবো। পাখির নিরাপদ বসবাসের পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করবো। কেউ পাখি শিকার করতে এলে তাকে ধরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে সোপর্দ করবো। সন্তান ও স্বজনদের মতোই আগলে রাখবো পাখিদের। আজ থেকে এই গ্রাম হবে পাখিদের অভয়াশ্রম। বন্যপাখি রক্ষায় মুষ্টিবদ্ধ এমনই শপথ নিলো মেহেরপুর গাংনী উপজেলার চেংগাড়া গ্রামবাসী।

পাখি নিধনের খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘটনাস্থলে গেলে পাখি নিধনের পরিবর্তে পাখি রক্ষায় শপথ নেন ওই গ্রামের আবাল বৃদ্ধ-বনিতা। মুষ্টিবদ্ধ শপথবাক্য পাঠ করান উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিন। গ্রামটির বিভিন্ন গাছ-গাছালিতে এখন বিলুপ্তপ্রায় পানকৌড়ি, নানা রকম বকসহ কয়েক প্রজাতির হাজারো পাখির মিলনমেলা। এখান থেকে বংশ বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে পাখিগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশায় বুক বেঁধেছেন গ্রামবাসী।

স্থানীয়দের তথ্যমতে, জেলার বিভিন্ন খাল-বিল ও মাঠেঘাটে এক সময় প্রচুর পরিমাণে পানকৌড়ি ও বকসহ নানা জাতের দেশীয় পাখির অবাধ বিচরণ ছিলো। কিন্তু গত ৫-৭ বছর ধরে দেশীয় পাখির কয়েকটি জাত প্রায় বিলুপ্তির পথে। এদের মধ্যে পানকৌড়ি ও বক জাতীয় কয়েক প্রকারের পাখি গত বছর থেকে চেংগাড়া গ্রামের একটি বাঁশবাগানে আশ্রয় নেয়। সেখানে বাসা বেঁধে পাখিগুলো ডিম পাড়ে। তা দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে শুরু করে। সম্প্রতি গ্রামের মানুষ পাখির বাচ্চা শিকারের ফলে পাখিগুলো ওই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। বংশ বিস্তার করতে না পেরে সংখ্যাও কমে আসছিলো। গ্রামের কতিপয় লোকজনকে পাখি নিধন থেকে নিবৃত্ত করতে পারছিলেন না পাখি রক্ষায় আত্মনিবেদিত কয়েক যুবক। শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিন সেখানে গিয়ে পাখির অভয়াশ্রম ঘোষণা করেন।

সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, হাজারো বাঁশ গাছের প্রতিটিতে ৪-৫টি করে পাখির বাসা রয়েছে। বাসাগুলোতে পানকৌড়ি ও বকের ছানাগুলোর কিচিরিমিচির শব্দে মুখরিত গোটা এলাকা। পাখির রাজ্যে গেলে যে কারও মন পুলকিত হবে। বিকেলে হলেই ছানাগুলোর পিতামাতা ফিরে আসে বাঁশবাগানে। সারাদিন পুকুর-নালা থেকে সংগ্রহ মাছ পেটের ভেতর থেকে বের করে ছানাদের খাওয়ানোর দৃশ্য দর্শনার্থীদের মনে মায়ার সঞ্চার করে। বাঁশবাগানের মাথার ওপর বিভিন্ন প্রজাতির পাখির উড়ে বেড়ানোর মনোরম দৃশ্য দেখতে অনেকেই ছুটে যান।

চেংগাড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা জানান, তিনিসহ কয়েক যুবক পাখি রক্ষায় উদ্যোগ নিলেও কাজ হচ্ছিলো না। প্রথমে গ্রামের শিশুরা খেলার ছলে পাখির বাচ্চা নিয়ে যায়। পরবর্তীতে বয়স্করাও পাখির বাচ্চা নিয়ে যায়। জবাই করে বাড়িতে বাড়িতে চলে পাখিভোজ। একজনের দেখাদেখি আরেকজন উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্যাচারের মাত্রা বাড়ায় পাখিগুলো অন্যত্র চলে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সহায়তায় তারা পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে একমত হয়েছেন।

বাঁশবাগান মালিক সামসুল ইসলাম জানান, এলাকা থেকে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই পরিবেশের ভারসম্য রক্ষায় পাখির প্রজনন মরসুমে বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাঁশ কাটা থেকে বিরত থাকেন তারা। কিন্তু গ্রামের মানুষের অত্যাচারে পাখি রক্ষা সম্ভব হচ্ছিলো না। যতোদিন এ বাঁশ বাগানে পাথি থাকবে ততোদিন প্রজনন মুসুমে বাঁশ কাটা হবে না বলেও জানান তিনি। গ্রামের বয়োবৃদ্ধ কয়েকজন জানান, পাখিরা আমাদের অতিথি। এক সময় পাখিদের আগমন গ্রামের শুভ খবর বলে ধরা হতো। এদের রক্ষা করা আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব।

গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিন গ্রামঘুরে বিস্ময় প্রকাশ করেন জানান, ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ির বসবাস এখন আর দেখা যায় না। এখানে যে পরিমাণ পনকৌড়ি আছে তার বংশ বৃদ্ধি হলে সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়বে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অভয়াশ্রম না থাকায় পাখি বিলুপ্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরে বলেন, গ্রামবাসী শিকারের পথ থেকে ফিরে রক্ষা শপথ করেছেন। যা দেশবাসীর জন্য একটি দারুণ সুখবর। গ্রামবাসীকে পাখি রক্ষায় সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে শিকারীদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার হুঁশিয়ারি করেন তিনি।