স্টাফ রিপোর্টার: গ্রামীণ ব্যাংককে নিজের আয়ত্তে রাখতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এমন কথা বিভিন্নভাবে জানা গেলেও এ প্রথম এমন একটি অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া হিলারি ক্লিনটনের হাজার হাজার ই-মেইলের মধ্যে এমন ৭টি ই-মেইল আছে। সম্প্রতি হিলারি ক্লিনটনের গোপন ই-মেইল মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে গেলে তারা সেটা ‘পাবলিক’ করে দেয়। তবে কিছু মেইলে হিলারি যা লিখেছিলেন, সেগুলো মুছে দেয়া হয়েছে। ক্লাসিফাইড নথি হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ২০২৫ সালে ওই মেইলগুলো প্রকাশ করার আগে সেখানে কী লেখা আছে, তা জানা যাবে না। হিলারি ক্লিনটনের প্রকাশিত ৭ হাজার মেইলের মধ্যে ৩১৭টি মেইলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। তার বেশ কয়েকটিতেই আছে গ্রামীণ ব্যাংকের কথা। কিছু ক্ষেত্রে যে আইডি থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মেইল পাঠানো হয়েছে, ক্লাসিফাইড হিসেবে তাদের পরিচয়ও মুছে দেয়া হয়েছে। তবে একাধিক মেইলে উল্লেখ আছে, ওই মেইলগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে পাঠানো হচ্ছে অথবা ওই মেইলগুলো গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত।
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে মেইল চালাচালি শুরু হয় ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। সেখানে প্রায় ২০০ ই-মেইলের মধ্যে অন্তত ৭টিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ই-মেইল আছে, যাতে ইউনূস হিলারির কাছে সাহায্য চেয়েছেন। একটি ই-মেইল থেকে জানা যায়, গ্রামীণ ব্যাংকে নিজের অবস্থান ফিরে পাওয়া এবং সেখানে তার অবস্থান সুসংহত করতে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। এ মেইলের একটি ড. ইউনূস নিজে লিখেছিলেন হিলারি ক্লিনটনের উদ্দেশ্যে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালীন কর্মকর্তা মেলানি ভিরবারের কাছে লেখা এ মেইলগুলো হিলারিকে ফরওয়ার্ড করা হয়েছিলো। হিলারির সাহায্য চেয়ে লেখা ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একটি ই-মেইলে ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ১৬ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সাথে বৈঠক করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত ওই বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার ইস্যু বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে তোলা যায় কিনা দেখো। এ ই-মেইলে ইউনূস আরো লিখেছেন, আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিলাম। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতই আমাকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেন আমার সমস্যা নিয়ে আমি সরাসরি কথা বলতে পারি। ৬ সপ্তাহ হয়ে গেলেও এখনো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কোনো সাড়া পাইনি। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেয়া প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম-এর ব্যাপারে ওই ই-মেইলে ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই আমাকে এ পদকের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল এই ব্যাপারে একটি শব্দও বলেনি। এ ই-মেইলের শেষে ড. ইউনূস লিখেছেন, বুঝতেই পারছো, সমস্যাটি কত গভীর! একই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর লেখা আরেকটি ই-মেইলে ইউনূস বলেছেন, কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে আমাকে নিয়ে ভয়ঙ্কর কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সম্মেলনে অংশ নিতে কয়েকদিনের মধ্যে নিউইয়র্কে যাচ্ছেন সেক্রেটারি হিলারির সাথেও তার দেখা হবে। দেখো, আমার ব্যাপারে তার এই কঠোর অবস্থান দূর করার কোনো উপায় বের করা যায় কিনা? তা না হলে ব্যাপারটি খুবই বিস্ফোরণের মতো ব্যাপার হবে। আমি তোমাকে শান্তি স্থাপনকারী (ইউনূস লিখেছেন পিসমেকার) হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। শিগগিরই দেখা হবে। এই ই-মেইল চালাচালির অনেক পরে ২০১১ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক এক আদেশে বয়স নির্ধারিত ৬৫ বছরের বেশি হওয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করে। ততোদিনে ইউনূসের বয়স অবশ্য ৭০ হয়েছিল। এরপরও ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে কাজে লাগানোর নানা রকম চেষ্টা করেন। ইউনূস অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের সবগুলো ধাপেই যান, তবে তার পক্ষে রায় যায়নি। সমালোচকরা বলেন, ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক দল গড়ার ঘোষণা দিয়েই মূলত আওয়ামী লীগের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন ড. ইউনূস। এ কারণে শেখ হাসিনা তখন ইউনূসকে সুদখোর বলেও মন্তব্য করেছিলেন।
২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর আরেকটি মেইল পাঠানো হয় মেলানিকে। এতেও প্রেরকের অংশটি শাদা রাখা হয়। মেইলের বেশ কিছু অংশ মুছে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে নিচে একটি নোটে পুরোপুরি প্রকাশ করা হয় ইউনূসের পরিস্থিতি। বিষয় হিসেবে লেখা হয়, যখন আমরা ভাবছিলাম, সবকিছু শান্ত হয়ে গেছে। ই-মেইলের একেবারে নিচে যোগ করা একটি নোটে লেখা প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, নোবেল বিজয়ী ইউনূসের বিরুদ্ধে বিদেশি সাহায্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অন্য কোম্পানিতে পাঠানোর যে অভিযোগ, সেসব পুনরায় তদন্ত করা হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ অনেক উদাহরণ তৈরি করেছে। টাকা আত্মসাৎ করে ধোঁকা দেয়াটাও একটা উদাহরণ। এসব আর কিছুই না, টাকা দিয়ে জনগণের টাকা নিয়ে নেয়ার একটা প্রক্রিয়া মাত্র। দরিদ্রদের জীবনে এতে কোনোই উন্নতি আসেনি। বরং তারা শুধু আরো বেশি বিদেশি সাহায্য পাওয়ার দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে মেইলে বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ গিনিপিগ হয়েছে, আমি কখনো এটা সমর্থন করিনি আর এখন প্রতিবাদ করছি। এই মেইলের এক স্থানে বলা বলা হয়, দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান লিখেছেন, আগে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের অংশ ছিল ৬০ শতাংশ এখন সেটা মাত্র ২৫ শতাংশ। মনে হয়, ইউনূস সরকারের তহবিল সম্ভব হলে পুরোই খালি করে দিতে চান। কিন্তু সরকার সেটা হতে দিতে চায় না। ওই মেইলটিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংককে এমন করে ধরে রাখা হয়েছে, যেন সেটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সেটারও তদন্ত হবে। গরিবরা এখানে শিকার হচ্ছেন। তাদের মিষ্টি কথায় ভোলানো হচ্ছে। অবশেষে সবই সামনে আসছে। শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি ইউনূসের আকর্ষণকে তার ক্যান্টনমেন্ট বাড়ির প্রতি খালেদা জিয়ার আকর্ষণের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক জনগণের সম্পত্তি। ভালোবাসার বাইরে সেটা বেসরকারিকরণ হয়েছে। ইউনূস সাহেব গ্রামীণ ব্যাংকের প্রেমে পড়েছেন। গরিবের টাকা নিয়ে কেউ খেলতে পারে না। ইউনূসের কিছু মেইল সরাসরি হিলারি ক্লিনটনকে না পাঠিয়ে মেলানি নামের একজন কর্মকর্তার কাছেও পাঠানো হয়। তিনি পরে সেগুলো হিলারি ক্লিনটনের কাছে ফরোয়ার্ড করেছেন।