স্টাফ রিপোর্টার: হজ নিয়ে মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সদস্যপদ হারানো আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আকস্মিকভাবেই সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে ১৫ মিনিটের এক বক্তৃতা দিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। জটিলতার মধ্যে নিজেই সংসদ সদস্য পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়ার এক সপ্তার মধ্যে মঙ্গলবার অধিবেশন কক্ষে ঢোকেন টাঙ্গাইল-৪ আসনের এই সংসদ সদস্য। স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বক্তৃতা দেন তিনি, যাতে হজ নিয়ে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়। শেষ পর্যায়ে সংসদ সদস্যপদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানান তিনি। সংসদ থেকে পদত্যাগপত্রটি সংসদের কর্মীদের মাধ্যমে স্পিকারের কাছে পাঠান লতিফ সিদ্দিকী। পদত্যাগপত্রটি অধিবেশনে পড়বেন কি-না- জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, তার প্রয়োজন নেই। বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর বহিষ্কৃত সদস্য ও সাবেক টেলিযোগাযোগমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংসদ সদস্যপদ ছাড়লেন তিনি। আজ আমার সমাপ্তি দিন। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ জানাচ্ছি না, নত মস্তকে ক্ষমা চাচ্ছি সবার কাছে। আমি মানুষের ভালোবাসায় বিশ্বাস করি। …আমার নেত্রীর অভিপ্রায়, আমি সংসদ সদস্য না থাকি।
এরপরই সংসদ পদ ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি দিয়ে প্রবীণ এ রাজনীতিক বলেন, টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে পদত্যাগপত্রটি আমি উপস্থাপন করছি। ৭টা ২৪ মিনিটে বক্তব্য শুরু করে ৭টা ৩৯ মিনিটে শেষ করেন তিনি। এ সময় অধিবেশন কক্ষে ছিলো পিনপতন নীরবতা। আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি আওয়ামী লীগার-এ পরিচয় মুছে দেয়ার মতো কোনো শক্তি পৃথিবীর কারও নেই-কারণ এ আমার চেতনা, আমার জীবনবেদ, প্রাণের রসদ, চলার সুনির্দিষ্ট পথ- এই বলে বক্তৃতা শুরু করেন লতিফ সিদ্দিকী।
এ সময় কয়েকজন সংসদ সদস্য টেবিল চাপড়ান। এর মধ্যে শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুও ছিলেন। আমু টেবিল চাপড়ানোর সময় তার হাত চেপে ধরতে দেখা যায় পাশের আসনে বসা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে। বক্তব্য শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় লতিফ সিদ্দিকী সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, গাজীপুরের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেলসহ কয়েকজনের সাথে করমর্দন করেন। মাগরিবের নামাজের বিরতির পর অধিবেশন কক্ষে ঢুকে সামনের সারিতে নিজের আসনে বসেন লতিফ সিদ্দিকী। তখন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন না অধিবেশনে। লতিফ সিদ্দিকী ঢোকার সময় বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন। প্রথমে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়ানোর জন্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সাড়া পাননি লতিফ সিদ্দিকী। স্পিকার শিরীন শারমিন বলেন, মাননীয় সদস্য, আপনি একটু পরে কথা বলেন। এর কিছুক্ষণ পর স্পিকারের সায় নিয়ে বক্তব্য শুরু করেন তিনি। অধিবেশন কক্ষে ঢোকার আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে স্পিকারের কার্যালয়ে গিয়ে শিরীন শারমিনের সাথে দেখা করেন লতিফ সিদ্দিকী। লতিফ সিদ্দিকী অধিবেশন কক্ষে যাবেন কি-না- তখন জানতে চাইলে শিরীন শারমিন বলেন, কেন যেতে পারবেন না? উনি তো এমপি। লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে গৃহীত হলে টাঙ্গাইল-৪ আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হবে। টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের বড় ভাই লতিফ ওই আসন থেকে একাধিক বার নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকীও একবার সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ভাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকীও সাবেক সংসদ সদস্য, যিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে এখন কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগ গঠন করে সে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগপত্রটি বিধিসম্মত হলে সংসদে কার্যপ্রণালী বিধির ১৭৮ (৩) অনুযায়ী বিষয়টি চলতি অধিবেশনেই সংসদকে জানাবেন স্পিকার।
আসন শূন্য ঘোষণা সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের পর বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানানো হলে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি। অবশ্য আগামী ৬ সেপ্টেম্বর লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ নিয়ে বিতর্ক নিষ্পত্তির শুনানি রয়েছে। তার আগেই নিজেই পদত্যাগ করলেন তিনি। প্রায় এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে মন্তব্য করে সমালোচনায় পড়েন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী।
গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাত দুটোর ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীর যতোটা বিরোধী, তার চেয়ে বেশি হজ আর তাবলিগের বিরোধী। এরপর বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
টাঙ্গাইল-৪ আসনের চার বারের সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে পাঁচ বছর তা পালন করেন। আর চলতি সরকারে তাকে দেয়া হয়েছিলো ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু ওই মন্তব্যের কারণে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর পদ থেকে সরানোর পাশাপাশি দলের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। দেশে ফেরার পর ওই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মামলায় নয় মাস কারাগারে কাটাতে হয় টাঙ্গাইলের এ সংসদ সদস্যকে। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান তিনি। লতিফকে বহিষ্কারের আট মাস পর বিষয়টি জানিয়ে আওয়ামী লীগের পাঠানো চিঠি গত ৫ জুলাই স্পিকার শিরীন শারমিনের হাতে পৌঁছায়। এরপর সংবিধান, মেম্বার অফ পার্লামেন্ট (ডিটারমিনেশন অব ডিসপিউট) অ্যাক্ট, সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ মেনে বিতর্ক নিষ্পত্তির কার্যক্রম নেয়া হয়। এ অবস্থায় লতিফের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি-না, তা মীমাংসার জন্য গত ১৩ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন। তার পরিপ্রেক্ষিতে মেম্বার অব পার্লামেন্ট (ডিটারমিনেশন অব ডিসপিউট) অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও লতিফ সিদ্দিকীকে লিখিত বক্তব্য দিতে বলে ইসি। লিখিত বক্তব্য পাওয়ার পর গত ২৩ আগস্ট শুনানিতে হাজির হয়ে টাঙ্গাইল-৪ আসনের এ সংসদ সদস্য বলেন, আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবো। এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে গেলাম। এ নিয়ে আর শুনানি করার দরকার নেই।