স্টাফ রিপোর্টার: কেরানীগঞ্জের সহজ-সরল যুবক মাহবুবুর রহমান শুভ। তার প্রতিবেশী ও পূর্বপরিচিত আশিকুর রহমান ওরফে জেবিনের আত্মীয় অসুস্থ। তাকে রক্ত দেয়ার জন্য শুভকে ঢাকায় নিয়ে আসে জেবিন। এজন্য তাকে ২০ হাজার টাকা দেয়ার লোভও দেখানো হয়। কখনও রক্ত দেয়নি তাই শুভ ভয় পাওয়ার কথা জানালে জেবিন অভয় দিয়ে বলে, রক্ত নেয়ার আগে ইনজেকশন দেয়া হবে। ফলে কোনো ব্যথা পাবে না। এভাবেই নিজেদের চক্রের মধ্যে থাকা ক্লিনিকে নিয়ে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে তার কিডনি কেটে নেয়ার পরিকল্পনা করে জেবিন ও তার দল। দুটি কিডনি কেটে নেয়ার পর শুভকে হত্যা করে লাশ গুমের পরিকল্পনাও করা হয়।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্র ধরে শুক্রবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয় জেবিনসহ ৫ জনকে। উদ্ধার করা হয় শুভ ও আবুল হাসান নামে দুজনকে। কিডনি চুরির বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রানা মোকাররম হোসেন জানান, কিডনি খোলার পর ৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেটা গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে কিডনি পাচার সম্ভব হয়। তবে প্রলোভন দেখিয়ে কোনো লোককে নিয়ে গিয়ে কিডনি কেটে নেয়া সম্ভব। কিডনি বা লিভার কেটে নিয়ে বিদেশে পাচার করার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার (এসি) মাহমুদা আফরোজ লাকি শুক্রবারের অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, কিডনি চোরচক্রের সাথে দেশি-বিদেশি কিছু ক্লিনিক মালিক ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জড়িত থাকতে পারেন। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তাদেরও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো- আবদুল জলিল, শেখ জাকির ইবনে আজিজ ওরফে শাকির, আশিকুর রহমান ওরফে জেবিন, ফজলে রাব্বি ও জিহান রহমান। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ চক্রের সদস্যদের অধিকাংশের বাড়ি বরিশাল। তারা কেরানীগঞ্জে ভাড়া থাকে। আগে তারা অজ্ঞান পার্টির সদস্য ছিলো। এখন তারা কিডনি পাচারের সাথে জড়িত। এ চক্রের মূল হোতা আবদুল জলিল।
একটি অনুসন্ধানী দল ক্রেতা সেজে কিডনি চোরচক্রের সাথে যোগাযোগ করে। চক্রটি জয়পুরহাট থেকে কিডনি বিক্রেতা আবুল হাসান ও কেরানীগঞ্জ থেকে শুভকে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে শুভকে ২০ হাজার টাকা এবং হাসানকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনে দেয়ার লোভ দেখায়। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম জানান, আবুল হাসানকে অটোরিকশা কিনে দেয়ার লোভ দেখিয়ে জয়পুরহাট থেকে ঢাকায় আনে চক্রের সদস্য আবদুল জলিল। সে এ চক্রের মূল হোতা। তাকে গাবতলী থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং হাসানকে উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জলিল জানায়, সে এ পর্যন্ত চারজনের কিডনি চুরি করেছে।
মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, আবদুল জলিলের কাছ থেকে শুভর কিডনি কেটে নিয়ে খুন করার পরিকল্পনার তথ্য মেলে। তার তথ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে অপর সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে দুটি চেতনানাশক ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ, একটি ধারাল ছোরা ও একটি তোয়ালে উদ্ধার করা হয়।
মনিরুল ইসলাম বলেন, শুভকে যাওয়া-আসার খরচ ও নগদ ২০ হাজার টাকা দেয়ার লোভ দেখায় জেবিন। জেবিন ঢাকায় তার চাচি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি, তাকে রক্ত দিতে হবে- এ কথা বলে শুভকে ঢাকায় আনে। ঢাকায় আনার আগে কৌশলে রক্তের গ্রুপও জেনে নেয় পাচারকারীরা। কিডনি কেটে নেয়ার পর শুভকে হত্যা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে লাশ ফেলে দেয়া অথবা গুম করার পরিকল্পনা ছিলো তাদের। শুভর কিডনি কোনো ক্লিনিকে বিত্তবান রোগীকে দেয়ার পরিকল্পনা ছিলো তাদের। তারা কৌশলে ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি বিক্রেতাকে ভারতে নিয়ে যায়। সেখানকার এক শ্রেণির ক্লিনিক মালিক ও চিকিৎসকের যোগসাজশে কিডনি কেনাবেচা করে।
এসি মাহমুদা আফরোজ লাকী জানান, প্রতারকচক্রের সদস্যরা প্রলোভন দেখিয়ে বহু মানুষের কিডনি চুরি করেছে। অনেক সময় তারা ভিকটিমকে দেশের বাইরে নিয়ে যায়। গ্রেফতার হওয়া আবদুল জলিল বেশ কয়েকবার ভারতে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, যাওয়ার সময় সে ভারতে লোক নিয়ে গেছে। সেখানকার কিছু ক্লিনিকের চিকিৎসকদের মাধ্যমে কিডনি কেটে নিয়েছে। তিনি আরও জানান, গত ডিসেম্বরে যাত্রাবাড়ীতে মেডিকেম জেনারেল হাসপাতাল ও উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দু রোগীর কিডনি কেটে নেয়া হয়েছিলো।