স্টাফ রিপোর্টার: বান্দরবান সীমান্তে বিজিবি ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মি’র সশস্ত্র সদস্যরা। গতকাল বুধবার সকালে জেলার দুর্গম থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের বড় মদক এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় বিজিবি সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছুঁড়ে। দুপুর পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে বড় মদক বিজিবি ক্যাম্পের নায়েক জাকির হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় আব্দুল গনি নামে অপর এক বিজিবি সদস্যও আহত হন। তবে আরাকান আর্মি’র কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়ার নিশ্চিত কোনো তথ্য মিলেনি।
এ ঘটনার পর সেনাবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টারে করে সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলের আশেপাশে আকাশপথে টহল দেন। এছাড়া দুপুরের পর আশেপাশের এলাকায় সেনা ও বিজিবি যৌথ অভিযানে নামে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই এলাকায় চিরুনি অভিযান চালানো হয়। তবে গহিন অরণ্যের কারণে সন্ধ্যার পর অভিযান বন্ধ করে দেয়া হয়।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এ অভিযান আবার শুরু হবে। এর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিপির কাছে ওই দেশের সীমান্ত সিল করে দেয়ার অনুরোধ জানায় বিজিবি। থানচি এলাকায় অভিযান চালানোর সময় আরাকান আর্মি’র সদস্যরা যেন পিছু হঠতে না পারে- সেজন্য এ অনুরোধ করা হয়েছে।
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার সকালে থানচির বড় মদক এলাকায় বিজিবি অভিযান চালিয়ে ১৩টি এরাবিয়ান ঘোড়া আটক করে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘোড়াগুলো আরাকান আর্মি চোরাচালানের মাধ্যমে সেখানে এনেছিলো। ১৩টি ঘোড়ার বাজার মূল্য আনুমানিক কোটি টাকার ওপরে। পরে ঘোড়াগুলো বিজিবি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। এই ঘোড়াগুলো আটকের জের ধরেই বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা হতে পারে বলে ধারণা বিজিবি মহাপরিচালকের।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেছেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন দমনের জন্য যে ধরনের অপারেশন দরকার, তা চালানো হবে। সেটা কমবিং (চিরুনি) অপারেশন বা যৌথ অভিযানও হতে পারে; যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটাতে পারে। তিনি জানান, বিজিবির আহত সদস্য জাকির হোসেনকে হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার চিকিত্সার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিজিবির অন্য সদস্যরা নিরাপদে বেজ ক্যাম্পে ফেরত এসেছেন।
থানচির রেমাক্রি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মালিরাম ত্রিপুরা বলেন, সকাল ৯টার দিকে বড় মদক এলাকার এক ইউপি সদস্য তাকে জানান যে বিজিবির সাথে আরাকান আর্মির গোলাগুলি শুরু হয়েছে। এতে এলাকার লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সিংগাফা মৌজার হেডম্যান মুই শৈ থুই মারমা ঘটনার কথা স্বীকার করে জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ওই এলাকায় যোগাযোগের কোন মাধ্যম না থাকায় সর্বশেষ পরিস্থিতি কি সে বিষয়ে কোনো কিছু জানা যাচ্ছে না।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, সকাল পৌনে ৯টার দিকে অতর্কিতভাবে বড় মদক বিজিবি ক্যাম্প লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি’র সশস্ত্র সদস্যরা গুলি করতে থাকে। প্রথম দফায় বিজিবি বুঝে উঠতে পারেনি কারা গুলি করছে। বিজিবিও আত্মরক্ষার্থে কয়েক রাউন্ড পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় নায়েক জাকির হোসেন গুলিবিদ্ধ হন।
সূত্র আরো জানায়, আরাকান আর্মি’র আকস্মিক এ হামলার পর আলীকদম সেনানিবাস, বান্দরবান সেনানিবাস এবং বিজিবির বলিপাড়া ব্যাটালিয়ন থেকে হেলিকপ্টারে করে বিপুল সংখ্যাক সেনা ও বিজিবি সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। বেলা ১২টা পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গুলি বিনিময়ের শব্দ শুনতে পাওয়া গেছে। এ সময় বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান ওই এলাকায় খুব নিচু দিয়ে টহল দিলে গোলাগুলি থেমে যায়। এরপর সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা যৌথ কম্বিং অপারেশন শুরু করে।
বিজিবির চট্টগ্রাম দক্ষিণ পূর্ব রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাবিবুল করিম জানিয়েছেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এদিকে গোলাগুলির পর থেকে বড় মদক বাজারে দোকান-পাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। স্থলপথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম না থাকায় হেলিকপ্টারের সাহায্যে অতিরিক্ত বিজিবি ও সেনা সদস্য পাঠানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজিবির প্রতিটি বিওপিকে (সীমান্ত ক্যাম্প) সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বান্দরবানের অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। তাদের মধ্যে আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) ও আরাকান ডেমোক্রেটিক পার্টি (ডিপিএ) অন্যতম। দীর্ঘদিন ধরে এই সংগঠনগুলো মাদক চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপকর্ম চালিয়ে আসছে। সংগঠনগুলো থানচি এলাকায় সাংগু নদীর দুই পাড়ে গহিন জঙ্গলে অবস্থান করে। ওইসব এলাকার সাথে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো যোগাযোগ নেই। এছাড়া বান্দরবানে ১৪৩ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৩১ কিলোমিটার সীমান্তেই কোনো বিওপি নেই। কয়েকদিন আগে থেকেই আরাকান আর্মি’র সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বড় মদক এলাকার কাছাকাছি অবস্থান নেয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের বিদ্রোহী বৌদ্ধদের নিয়ে ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল আরাকান আর্মি গঠিত হয়। তারা মিয়ানমারের কোচিন বিদ্রোহীদের সাথে এক হয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের আরাকান রাজ্যে তাদের অবস্থান। আরাকান আর্মি’র ৪শথেকে ৫শ সদস্য রয়েছে। টুং ম্রাট নাইয়ং এ সংগঠনের প্রধান কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। নাউ টুং অং আরাকান আর্মি’র সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। আরাকানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র লড়াই করছে আরাকান আর্মি।