সৃজনশীল ধুঁকছে দক্ষ শিক্ষকের অভাবে

স্টাফ রিপোর্টার: ক্লাসে পড়ানো, প্রশ্ন তৈরি এবং পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে দক্ষ শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে সৃজনশীল পদ্ধতি। শিক্ষকদের দুর্বল প্রশিক্ষণ ও ক্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের কাছে বোঝায় পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গাইড বই অনুসরণ করে ক্লাসে পাঠদান এবং প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। একইভাবে বেড়েছে কোচিং নির্ভরতা। নতুন এ ব্যবস্থায় শহরের চেয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দিয়ে এ পদ্ধতি প্রবর্তন করায় শুরুতেই ভুল হয়েছে। ছয় বছর ধরে বিভিন্ন শ্রেণিতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন পাঠ্যবই। কিন্তু ওইসব বিষয়ে কোনো শিক্ষক তৈরি করা হয়নি। স্কুল পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি এবং পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন যথাযথ হচ্ছে কি-না তা মনিটর করা হয়নি। জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন তৈরি এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়নি। এসব কারণে গত ৬ বছরে সৃজনশীলের মতো আধুনিক পদ্ধতিটির বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৫ ভাগ।

নতুন এ পদ্ধতি সম্পর্কে ৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমরা সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছি। হয়তো আমাদের ভুল-ক্রুটি আছে। সবাইকে প্রস্তুত করতে পারিনি। তারপরও এখন এ পদ্ধতিকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে।

সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়ন কর্মসূচির যুগ্মপরিচালক (জেপিডি) রতন রায় রোববার সকালে বলেন, পাঠদান- প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরীক্ষা আর শিক্ষার্থী মূল্যায়নে যে সমস্যা হয়েছে তা শিক্ষকের মানের কারণে। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকের মান কাঙ্খিত নয়। অনেকে প্রশিক্ষণের ভাষাও বোঝেন না। তাছাড়া অনেক শিক্ষকের এ ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও উদ্যোগের অভাব আছে। তিনি বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন আর প্রশিক্ষণ একই সাথে শুরু হয়েছে। আগে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। প্রত্যেক শিক্ষককে একবার করে হলেও তিন দিনের সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবিরই এক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষকরা এই পদ্ধতি বোঝেন না। তারা গোঁজামিল দিয়ে পড়াচ্ছেন। সনাতনী পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা কিছু হলেও শিখতে পারত। কিন্তু এখন বলতে গেলে কিছুই শেখে না। আমরা অন্ধকারের দিকে হাঁটছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সৃজনশীল পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নের উত্তর লিখবে না। এজন্য তাদের অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে ক্লাসে পাঠদানের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে। পরীক্ষার প্রশ্ন হবে সৃজনশীল উত্তর দেয়ার উপযোগী করে। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নও হবে সৃজনশীলে দক্ষ শিক্ষকদের দ্বারা। অর্থাৎ পাঠদান বা পড়ানো, প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরীক্ষা নেয়া এবং খাতা মূল্যায়ন- এ তিন ক্ষেত্রেই সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ থাকবে। এ তিনটির নেপথ্যেই কারিগরের ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষক। তাদের নতুন এ পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, সেই শিক্ষকদেরই সৃজনশীলতার দারুণ অভাব রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে যে সংখ্যক শিক্ষক আছেন তাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। যাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই এ পদ্ধতি বোঝেন না। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মূলত নামমাত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার কারণে এমন হয়েছে। ফলে সৃজনশীলে অদক্ষ ও অযোগ্য এবং সৃজনশীল না বোঝা শিক্ষক দিয়ে চলছে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের কাজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগের উদ্যোগ খুবই ভালো। কিন্তু এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন চলছে গোঁজামিল দিয়ে। সূত্র জানায়, সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় মোট শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। অথচ সরকারি হিসেবে পাঁচ লাখ শিক্ষককে সৃজনশীলের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সাড়ে তিন লাখ শিক্ষকের ভেতর থেকে মুখ চেনাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঁচ লাখের সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে নয় হাজার শিক্ষক আছেন যাদের ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এদের ওপর ভর করেই চলছে সৃজলশীল পদ্ধতি। এরাই প্রশ্ন তৈরি করছেন। কাজ করছেন প্রধান পরীক্ষক হিসেবে। এদের অধীনে কয়েক লাখ শিক্ষক জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন। যাদের কিছুসংখ্যকের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ মাত্র তিন দিনের। এছাড়া প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের সংখ্যাও অনেক।

বিগত দুই থেকে আড়াই বছরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে একাধিক নতুন দিক। এর একটি হচ্ছে, ২০১৩ সালে চালু করা নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবই। অপরটি হচ্ছে, গত ২১ মাসে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় নিয়োগ পেয়েছে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক। এ নতুন শিক্ষকরা কারিকুলাম এবং সৃজনশীল পদ্ধতির সম্পর্কেই প্রশিক্ষণ পাননি। পুরনো শিক্ষকদের অধিকাংশ পেয়েছেন নামমাত্র প্রশিক্ষণ। এর প্রভাব পড়েছে পাঠদান, প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরীক্ষা নেয়া এবং শিক্ষার্থী মূল্যায়নে। ফলে শিক্ষার্থীরা কখনও অতি মূল্যায়ন আবার কখনও কম মূল্যায়নের শিকার হচ্ছে।