বাংলা-ইংরেজি নকল বইয়ের খপ্পরে শিক্ষার্থীরা

 

স্টাফ রিপোর্টার: উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি জটিলতার পর এবার নকল বইয়ের খপ্পরে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি বই-বাংলা, ইংরেজি এবং বাংলা সহপাঠ। বই তিনটি এনসিটিবি সময়মতো বাজারজাত করতে পারেনি। সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু প্রকাশকরা বই তিনটি নকল করে বাজারে ছেড়েছে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে সরকার অনুমোদিত জনপ্রিয় পাঠ্যবইগুলোও নকল হচ্ছে। নকল বই বাজারে আসায় সরকারের মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে আসল বই পড়ার সুযোগ থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় আগেভাগেই বইয়ের পাণ্ডুলিপি নকলবাজ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। তারা দ্রুত ছাপিয়ে আসল বইর আগেই বাজারে ছেড়ে দেয়। সরকারিভাবে বই ছাপায় দেরি হওয়ায় নকল বই বাজার দখল করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে ২০১৩ সাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বই নতুনভাবে তৈরির কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে গতবছর বাংলা প্রথমপত্র ও সহপাঠ নতুন রূপে প্রণীত হয়। ইংরেজি প্রথমপত্র এবার নতুন করে লেখা হয়েছে। নতুন হওয়ায় গতবছর বাংলা বই নকল করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, নতুন হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি বই কী করে নকল হলো।

জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র পাল গতকাল শুক্রবার বিকেলে বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সরকারি এবং বেসরকারি উভয় পর্যায়ের পাঠ্যবই নকল হচ্ছে। কয়েকদিন আগে এ নকল বই ধরতে গিয়ে ময়মনসিংহে কিছু লোক বিপাকেও পড়েছিলো। পরে আমরা এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকীকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বিষয়টি সমাধান করেন। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া নকল প্রতিরোধে আমাদের নিজস্ব কোনো ম্যাকানিজম নেই। বেসরকারি প্রকাশকদের কর্মীবাহিনী আছে। কিন্তু তারাও এ কাজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে। এ অবস্থায় আমরা পুলিশের সহায়তা চেয়ে গত সোমবার বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) চিঠি দিয়েছি। তাতে নকল বই পেলেই ধরার জন্য অনুরোধ করেছি। এক প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেন, এক কপি বই বাজারে গেলে সেখান থেকে হাজার কপি করা সম্ভব । আমরা জানি না কীভাবে বই নকল হয়েছে। তবে এনসিটিবি থেকে বই বা পাণ্ডুলিপি ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এমন অভিযোগ করে থাকলে তা সম্পূর্ণ ভুল।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, আগে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক উভয় স্তরের পাঠ্যবই নকল করত। গত ৬ বছর ধরে মাধ্যমিকের বই বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। ফলে এ স্তরের বই নকলে তাদের আগ্রহ নেই। নকলকারীদের নজর উচ্চ মাধ্যমিকে। এছাড়া এনসিটিবির বিনা মূল্যের বই, বাংলা একাডেমির বিভিন্ন অভিধান, ব্যাকরণ এবং জনপ্রিয় লেখকের উপন্যাস-গল্পের বইও নকল করছে। তিনি বলেন, বছরে এ খাতে যে ব্যবসা হয়, তার এক-চতুর্থাংশ অর্থই হাতিয়ে নিচ্ছে নকলকারীরা। এ অর্থের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ১০০ কোটি টাকা হবে।

এদিকে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেছেন, নকল বইয়ের কারণে শুধু শিক্ষার্থী কিংবা বেসরকারি প্রকাশকরাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, সরকারও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। এবার এইচএসসির বাংলা, ইংরেজি এবং বাংলা সহপাঠ বই তিনটির স্বত্ব এনসিটিবির। বেসরকারি প্রকাশকদের মাধ্যমে বাজারজাত হচ্ছে। এ জন্য এনসিটিবির সাথে বই বাজারজাত করা বেসরকারি প্রকাশকদের চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী প্রতি বই থেকে সরকার ১১ ভাগ হারে রয়্যালটি পাওয়ার কথা। এরপরের লাভ পাওয়ার কথা বই বাজারজাতকারী ১৭ প্রকাশকের। ঢাকা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী এ বছর তিন দফায় ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। চতুর্থ দফায় ভর্তি হয় আরও ২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এক হিসেবে দেখা গেছে, ভর্তি হওয়া এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেক বা ৫ লাখও যদি বাংলা, বাংলা সহপাঠ ও ইংরেজি এ তিনটি নকল বই কেনে, তবে সরকারেরই গচ্চা যাবে অন্তত সোয়া ১ কোটি টাকা। আর প্রকাশকদের ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ১ কোটি টাকা। এ গোটা টাকাই চলে যাবে জালিয়াত চক্রের পকেটে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলা বইয়ের দাম ১০২ টাকা, সহপাঠের দাম ৪৮ আর ইংরেজির দাম ৭৭ টাকা। ইতঃপূর্বে ৩৮ জন এজেন্টের মাধ্যমে এসব বই সরকার বাজারজাত করতো। কিন্তু নকলকারীদের কাছে বেশি লাভ পাওয়ায় অনেক এজেন্টই সরকারি বই বিক্রি করত না। এ কারণে গতবছর থেকে এ তিনটি বই ১৭ জন প্রকাশকের মাধ্যমে ১১ ভাগ রয়্যালটি নিয়ে বাজারজাত করছে। আর এ স্তরের বাকি বই বেসরকারি প্রকাশকরা নিজেদের লেখক দিয়ে লিখিয়ে এনসিটিবি থেকে অনুমোদন নেয়। এরপর তারা নিজেদের মতো করে বাজারজাত করে। তবে এ স্তরে যে কজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তাদের প্রত্যেককে সরকারি তিনটি বই কিনতেই হয়। যে কারণে নকলকারীরা এ তিনটি বই বেশি নকল করে। তবে বেসরকারি প্রকাশকদের জনপ্রিয় বইও নকল হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গত ১২ জুলাই এক অভিযানে বগুড়ায় মোয়াজ্জেম হোসেন ভূইয়া রচিত ভূগোল বইটির নকল পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। তবে চলতি মাসে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় নকল বই ধরতে গিয়ে বাপুসের ৬ কর্মকর্তা উল্টো ফেঁসে যান। স্থানীয়দের চাপে তাদের পুলিশ আটক করে। পরে এরা চার দিন জেলও খেটেছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বই নকল হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী। তিনি বলেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা নকল বই বিক্রির অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গত জুলাই মাসে অভিযান চালিয়েছি। একটি বাঁধাই কারখানায় নকল বইয়ের কাভার উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় শহীদুল নামে ওই কারখানার মালিককে পুলিশ আটক করেছে। তিনি জানান, নকল বই বিক্রি ঠেকাতে পুলিশ সুপারদের সহায়তা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রকাশক সমিতির সহায়তাও কামনা করেছি। তারা আলাদাভাবে কাজ করছে। এরপরও প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হবে। তবুও নকল প্রতিরোধ করা হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইতঃপূর্বে ঢাকায় নকলের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ছিলো। এরপর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, যশোর ও বগুড়া অঞ্চলে এই ঘাঁটির বিস্তার ঘটে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ময়মনসিংহসহ আরও কয়েকটি জেলায় এর বিস্তার ঘটেছে। নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবির কর্মকর্তা এবং বাপুসের নেতারা বলেছেন, নকলবাজরা স্থানীয়ভাবে এক শ্রেণির রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক নেতার প্রশ্রয় পায়। এ দুটি পক্ষের সাথে কোথাও কোথাও প্রশাসনের দু-চারজন কর্তাব্যক্তিও ভিড়ে গেছেন। যে কারণে নকলের বিস্তার থামছে না।

সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, তাদের পরিদর্শকরা মানিকগঞ্জে আজাদ লাইব্রেরি, নবীনগরে স্টুডেন্ট লাইব্রেরি, সাভারে জামাল লাইব্রেরিতে এনসিটিবির জলছাপবিহীন বই পেয়েছেন। বগুড়ায় রোববার অভিযানে নকল বই পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নোয়াখালীর চৌমুহনী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বই নকল হয়ে থাকে। এসব জেলায় সমিতির পরিদর্শকরা অভিযানে যাবেন বলে জানান তিনি। সমিতি সূত্র জানিয়েছে, বগুড়ায় জহিরুল ইসলাম ও ইকবাল, চৌমুহনীতে রাশেদ-মুরাদ ভ্রাতৃদ্বয়, চট্টগ্রামে ঝুলন বাবু, রংপুরে হাবিব, আরিফ, যশোরে রাসেল ও মিতুল, ঢাকায় বাংলাবাজারে জনি, মিজান, এমরান প্রমুখ এসব নকলের কাজে জড়িত।

Leave a comment