হাকিমের বাসা থেকে শিশু উদ্ধার : গায়ে ৩০ ক্ষত!

সাতক্ষীরায় বিচারিক হাকিমের বাসায় শিশু গৃহপরিচালিকা নির্যাতন?

 

Sathkhira-3(1)

ষ্টাফ রিপোর্টার: সাতক্ষীরার বিচারিক হাকিম নুরুল ইসলামের বাসা থেকে বীথি (১০) নামের এক শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। বীথি নুরুল ইসলামের বাসায় কাজ করতো। পুলিশ বীথির গায়ে পোড়া, ছ্যাকা ও আঘাতের ৩০টিরও বেশি চিহ্ন পেয়েছে। হাকিম নুরুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার বাদেমাজু গ্রামের বাসিন্দা বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, প্রতিদিনই মেয়েটির ওপর নির্যাতন করা হয়। তবে বীথি এ ব্যাপারে কিছুই জানাচ্ছে না পুলিশ ও অন্যদের। গতকাল বুধবার বীথিকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে সদর থানা পুলিশ। বর্তমানে বীথি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সাতক্ষীরা শহরের টাউনবাজার ব্রিজের বিপরীতে পলাশপোল মহল্লায় আকরাম হোসেনের বাড়িতে ভাড়া থাকেন বিচারিক হাকিম নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নাতাশা। এ দম্পতির রেহান নামে প্রায় দেড় বছর বয়সী একটি শিশু আছে। নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘরের কাজের পাশাপাশি শিশু রেহানাকেও দেখাশোনা করতে হতো বীথিকে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গতকাল বুধবার দুপুর ১টার দিকে মেয়েটি বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পানি দাও, পানি খাবো বলে আকুতি জানালে কয়েকজন প্রতিবেশী ওই বাসায় যায়। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় তারা তাকে সাহায্য করতে পারেনি। পরে খবর পেয়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদ শেখ পুলিশ সদস্য নিয়ে সেখানে যান। এরপরও ভেতর থেকে দরজা খুলতে অস্বীকৃতি জানানো হয়।

খবর পেয়ে সহকারী পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার সাঈদ এবং সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ্ আব্দুল সাদী ঘটনাস্থলে পৌঁছান। একই সময় পৌঁছান সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা ও তার সহকর্মী বিচারিক হাকিম শিমুল কুমার বিশ্বাস। তাদের সাথে ছিলেন অভিযুক্ত বিচারিক হাকিম নুরুল ইসলাম। এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দরজা খুলে দেয়া হয়। তখন শিশু বীথিকে উদ্ধার করে পুলিশ।

বীথি নিজের ক্ষতচিহ্ন দেখাতে বার বার অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি ওড়না সরিয়ে মাথা ছাড়াও পিঠ হাত দেখাতেও অস্বীকৃতি জানায়। পরে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কোহিনুর ইসলাম ও নারী নেত্রী নাসরিন খান লিপির অনুরোধে সে ক্ষতচিহ্নগুলো দেখায়। মেয়েটির মাথার চুল সদ্য কাটা অবস্থায় দেখা যায়। মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ সাংবাদিকরা তা প্রত্যক্ষ করেন। নুরুল ইসলাম এ সময় বলেন, বীথির দেহে এগুলো কীসের দাগ তা বীথির কাছে জিজ্ঞাসা করুন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বারবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে বীথি বলে, সে এ বাসায় মেয়ে রেহানকে দেখাশোনা করে। তার দেহে কেউ নির্যাতন করেননি। এগুলো সব মশার কামড়ের দাগ। বারবার সে একই কথা বলতে থাকে। সে জানায়, সে ভালো আছে। কেউ তাকে মারধর করেনি। খালা ও খালু তাকে খুব ভালোবাসেন। তবে একাধিক প্রতিবেশী অভিযোগ করেন, নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নাতাশা প্রায়ই শিশুটির ওপর নির্যাতন করেন। প্রতিবেশীরা মেয়েটির চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেও তার সাথে তারা কথা বলতে দিতেন না। দিনভর ঘরের দরজা বন্ধ থাকতো। বীথি জানিয়েছে, তার বাবার নাম রসুল আলী। সে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বড় আমিয়ান গ্রামের বাসিন্দা। তৃতীয় শ্রেণিতে যখন সে পড়তো, তখন তার বাবা তার মাকে ওষুধ খাইয়ে হত্যা করে বলে বীথি অভিযোগ করে। ওই শিশু আরো জানায়, সাতক্ষীরা আদালতের কর্মচারী সোহরাব হোসেন নামে তার এক চাচা তাকে নূরুল ইসলামের বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে নিয়োগ করান।

নুরুল ইসলাম মেয়েটিকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, গত ২৪ মে তার ছেলে তানজিম আহমেদ (৩) নিজ ঘরে রাখা টেলিভিশনের ট্রলিতে চাপা পড়ে মারা যায়। তার কিছুদিন পর বীথিকে কাজের মেয়ে হিসেবে তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

নুরুল ইসলামের প্রতিবেশীরা তানজিমের মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। তবে এসব নিয়ে নুরুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করেননি। অন্যদিকে নুরুল ইসলামের স্ত্রী নাতাশা বাড়ির একটি কক্ষে দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন। কারো সাথে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, মেয়েটিকে আপাতত চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে।

সাতক্ষীরার সহকারী পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার সাঈদ জানান, আমাদের কাছে খবর আসে যে বিচারিক হাকিম নুরুল ইসলাম তার বাসার কাজের মেয়েকে নির্যাতন করেছেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তারা দরজা খোলেন। তিনি আরো বলেন, মেয়েটির দেহে অনেক ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে। চিকিৎসকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টি আরও নিশ্চিত করে বলা যাবে। তিনি আরো বলেন, যেহেতু প্রাথমিকভাবে বীথি তার ওপর নির্যাতনের কথা স্বীকার করেনি, সেজন্য আপাতত নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। মেয়েটির জবানবন্দি রেকর্ড করার পর এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। সন্ধ্যার পর নুরুল ইসলামের বাড়িতে আবারও পুলিশ যায়। এ ব্যাপারে ওসি এমদাদ জানান, আইনগত ব্যবস্থা নিতেই তারা সেখানে গেছেন।