ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯২ হাজার কোটি টাকা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য : ৩৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন

 

স্টাফ রিপোর্টার: ব্যাংকিং খাতে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। শুধু তাই নয়, নিয়ম ভেঙে দেয়া বেশিরভাগ ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৩৭ হাজার ২৫২ কোটি ১৫ লাখ টাকার মন্দ ঋণ অবলোপন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। বর্তমানে অবলোপন করা মন্দ ঋণ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে মোট খেলাপির পরিমাণ ৯১ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছর আগে (২০১৪ সালের মার্চ শেষে) ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণ ছিল ৩১ হাজার ৪৩৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে অবলোপনকৃত ঋণ বেড়েছে পাঁচ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। আর তিন বছরের ব্যবধানে অবলোপনকৃত ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা মন্দ বা খেলাপি ঋণ একপর্যায়ে ব্যাংকের স্থিতিপত্র (ব্যালান্স শিট) থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বলা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকের মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে মন্দ ঋণের বিপরীতে। ব্যাংকগুলো মূলত আর্থিক সূচকের উন্নতি দেখানোর কৌশল হিসাবে ঋণ অবলোপন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে যে ঋণ অবলোপন হচ্ছে ওই গ্রাহকের বিরুদ্ধে বাড়তি শুধু একটি মামলা করতে হয়। ফলে ব্যাংকের স্থিতিপত্র দুর্নামমুক্ত হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ৫ বছরের আগের ঋণ এ প্রক্রিয়ায় অবলোপন করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো বর্তমানে বিধি ভঙ্গ করে এক বছরের পুরনো ঋণও অবলোপন করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম বিশেষ করে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, আনন্দ শিপইয়ার্ড, নূরজাহান গ্রুপ, বেসিক ব্যাংকসহ বড় ধরনের আর্থিক কেলেংকারিতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এসব কেলেংকারির অর্থ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় ব্যাংকগুলো খেলাপি কম দেখাতে ঋণ অবলোপন করছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে শৃংখলা না থাকায় এমনটি হচ্ছে। একদিকে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দিচ্ছে ব্যাংক, অন্যদিকে ঠিকভাবে আদায় হচ্ছে না। এ কারণে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা একপর্যায়ে অবলোপন করতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছর অবলোপনের পরিমাণ বাড়ছে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংকগুলোর স্থিতিপত্র (ব্যালান্স শিট) পরিষ্কার রাখার জন্য ২০০৩ সালে অবলোপন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে অবলোপন করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মার্চ ২০১৫ শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানার চার ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক অবলোপন করেছে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা।

অবশ্য ২০১৪ সালের মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছিল ১৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ১৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা।

এদিকে মন্দ ও অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর তহবিল খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ঋণের সুদের ওপর। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ অবলোপন সংক্রান্ত একটি নীতিমালা জারি করা আছে। ওই নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণ অবলোপন করতে পারে। নীতিমালার বাইরে গিয়ে কেউ ঋণ অবলোপন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a comment