স্টাফ রিপোর্টার: সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিলো, ছিলো না চাঁদ/ভোরের আলোয় তোমার রক্ত মুছে গেলো সমুদ্র সমতল… ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মর্মস্পর্শী দৃশ্যপট এভাবেই চিত্রিত করেছেন অধ্যাপক আবু সায়ীদ। সেই রক্তভেজা ১৫ আগস্ট আজ। জাতীয় জীবনের কালিমালিপ্ত ও বেদনাময় দিন। ১৯৭৫ সালের এদিন পুব আকাশে সূর্য ওঠার আগেই সপরিবারে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কালো আঁধারে ঢেকে দেয়া হয় কোটি হৃদয়ের প্রিয় মুখচ্ছবিকে। আর বাঙালি জাতির ললাটে অঙ্কন করে কলঙ্কের তিলক, যা থেকে দেশ-জাতি আজো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। তবে প্রিয় নেতার শাহাদাতের ৪০তম বার্ষিকীতেও তিনি জ্বল জ্বল করছেন প্রতিটি মানুষের বুকে। বাঙালি আজো নিজের অজান্তে গেয়ে ওঠেন- ‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেতো, বঙ্গবন্ধু মরে নাই/যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো- ‘বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই, বঙ্গবন্ধু তুমি আমার সোনার বাংলাদেশ… মানচিত্রে ছড়িয়ে আছে তোমার ছবির রেশ’, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ্য মুজিবরের কণ্ঠ’সহ শত গান। আবৃত্তি করেন মহানায়ককে নিয়ে লেখা অন্নদাশঙ্কর রায়, শামসুর রাহমান, আখতারুজ্জামান আজাদসহ অসংখ্য কবির কবিতা। কারণ তিনিই তো পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান পুরোধা, সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও বাঙালি হৃদয়ের স্পন্দন।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী তথা জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সংঘটিত পৈশাচিক ওই হত্যাকাণ্ডের দুঃসহ স্মৃতি আজো কোটি বাঙালির হৃদয়কুঠিরে নাড়া দেয়। বিপথগামী সেনা কর্মকর্তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে কিছু কুলাঙ্গার রাতের অন্ধকারে নারকীয় পন্থায় হামলা চালায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের ওপর। রক্তে ভাসিয়ে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু ভবনকে। ছিন্নভিন্ন করা হয় পরিবারের সদস্যদের দেহ। গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে যায় প্রিয় নেতার বুক ও পেট। নরপিশাচরা বাসভবনে যেখানে যাকে পেয়েছে, সেখানেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে নির্মমভাবে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও জঘন্য এই হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি জাতির পিতার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, জামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্ত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা, সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বঙ্গবন্ধুর দু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় তারা প্রাণে রক্ষা পান।
ইতিহাস বলে, বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সাথে অটুট বন্ধন ছিলো বঙ্গবন্ধুর। তিনি ব্যক্তিগত সম্পদ বুঝতেন না। যখন যা পেতেন, জনগণের জন্য উজাড় করে দিতেন। জনগণের ভালোবাসাই ছিল তার একমাত্র সম্পদ, যে সম্পদ কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারে না। আর পারেনি বলেই ১৫ আগস্ট এলেই তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়। তাকে কোনো বাঙালি হত্যা করতে পারে- এমন বিশ্বাস কারো মনে ছিলো না, ছিলো না বঙ্গবন্ধুর মনেও। এ কারণেই গোয়েন্দা সংস্থা ও ঘনিষ্ঠজনদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গভবনের মতো সুরক্ষিত স্থানে না থেকে সাধারণ মানুষের মতো থেকেছেন ধানমণ্ডিতে অরক্ষিত নিজ বাড়িতে। প্রতিটি মুহূর্ত থেকেছেন গরিব-দুখি মানুষের মাঝে। আর এটাই তার জীবনের কাল হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ওই ঘাতকচক্র হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে, যা শুধু বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশের নয়, পুরো বিশ্বের বিরল মর্মান্তিক ঘটনা। মহাত্মা গান্ধী, লুথার কিং, লিংকন, লুমুম্বা, কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু কাউকেই বঙ্গবন্ধুর মতো সপরিবারে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়নি।
যে কাজটি বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীও করার সাহস করেনি, সেটিই করেছে সেনাসদস্য নামধারী এ দেশের গুটিকয়েক কুলাঙ্গার। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন তখনই ঘটানো হয় এ নৃশংস ঘটনা। পরিসমাপ্তি ঘটে একটি ইতিহাসের। সে থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলার আকাশ-বাতাস-মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকরা, যা কোনোদিন হয়নি, হবেও না। পৃথিবীতে বাঙালি জাতি যতোদিন থাকবে ততদিনই থাকবে বঙ্গবন্ধুর নাম ও তার কর্ম।
পঁচাত্তরপরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। এতে ১৫ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন জজ আদালত। এর বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করলে ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের একক বেঞ্চ ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। অপর ৩ জনকে বেকসুর খালাস দেন। পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট লিভ টু আপিল করলে ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করেন। আপিলে খুনিদের ফাঁসির রায় বহাল রাখে আপিলাত ডিভিশন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১০ সালে। এর ফলে দীর্ঘদিন পর কলঙ্কমুক্ত হয় বাঙালি জাতি। বুক থেকে নামে শোকের পাথর।
যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ৬ খুনির মধ্যে ৩ জনের অবস্থান জানা যায়নি। আর তিনজনের অবস্থান নিশ্চিত হলেও আইনি জটিলতায় তাদের ফেরত আনা সম্ভব হচ্ছে না। যে তিন খুনির সন্ধান জানা যায়নি তারা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম ও ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ। আর অবস্থান নিশ্চিত হওয়া কানাডায় অবস্থানকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এমএইচবি নুর চৌধুরী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণকারী কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সক্রিয় কূটনৈতিক সাড়া মেলেনি। তাছাড়া কানাডায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকায় নুর চৌধুরীকে হস্তান্তরে দেশটি আগ্রহী নয়। এ নিয়ে আইনি লড়াই চলছে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকায় রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সমস্যা হচ্ছে। আরেক খুনি মোসলেম উদ্দিনও সেখানে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিগত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের পুনঃসিদ্ধান্ত হয়। একই সাথে ওইদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যদিয়ে দীর্ঘদিন পর দিবসটি আবারো রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়।
দিবসটিকে ঘিরে গোটা জাতি আজ বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক জানাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হবে। সারাদেশে জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত। দিবসটিতে ইতোমধ্যেই সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এবারো সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে দিবসটির বিভিন্ন কর্মসূচি। সরকারি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন। এ ছাড়া বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্র্রচার এবং সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।
আজ সকাল পৌনে ৭টায় ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বার রোডে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন এবং সশস্ত্র বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এ সময় বিশেষ মোনাজাত ও কোরআন তেলাওয়াত অনুষ্ঠিত হবে। এ দিনটিকে কেন্দ্র করে পোস্টার, সচিত্র বাংলাদেশের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে স্ব স্ব কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। দেশের সব জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালনের জন্য আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলসহ জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এদিকে চুয়াডাঙ্গায় দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের লক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সকালে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বয়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সকাল সাড়ে ৯টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে একটি ৱ্যালি বের করা হবে। ৱ্যালিটি শহর প্রদক্ষিণ শেষে শ্রীমান্ত টাউনহলে এসে শেষ হবে। ৱ্যালি শেষে বঙ্গবঙ্গু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। সকাল ১০টায় শ্রীমান্ত টাউনহলে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শণ করা হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। বাদ জোহর সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত, মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সুবিধাজনক সময়ে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে।