ভুয়া প্রশ্নপত্র ও সৃজনশীল পদ্ধতিই ডুবিয়েছে

 

স্টাফ রিপোর্টার: এইচএসসিতে যশোর বোর্ডে ভয়াবহ ফল বিপর্যয়ের পেছনে অন্যতম কারণ ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস। এমনটিই বলছেন শিক্ষক, পরীক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ শুধু কোচিং ও গাইডবইমুখি হয়ে পড়ায় মূল বইয়ের দিকে তেমন নজর দেয়নি। এ ভুল সিদ্ধান্তও তাদের ফেলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এছাড়া এবার নতুন সিলেবাসে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়ায় শিক্ষার্থীরা ফল ভালো করতে পারেনি। এতে করে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বেশি খারাপ করেছে। নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়াটাও ভুল হয়েছে। প্রশ্ন কঠিন হওয়ার বিষয়টি নিয়েও জোর সমালোচনা হচ্ছে। তবে শিক্ষাবোর্ড সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এর দায় বোর্ড নেবে না। গতকাল সোমবার যশোর বোর্ডের ফলাফল-পরবর্তী বিশ্লেষণ করেন শিক্ষা বোর্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন কলেজ শিক্ষক, অভিভাবক ও ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী।

এ বছর যশোর বোর্ডের গড় পাসের হার ৪৬.৪৫ শতাংশ। এর আগে ২০০৪ সালে পাসের হার ছিলো ৪২ দশমিক ৭০ শতাংশ। ১১ বছর পর আবার এমন ফল বিপর্যয়ে হতবাক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বোর্ড কর্মকর্তারা। এ বছর মানবিক বিভাগের ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৪১ দশমিক ১৯ শতাংশ ও বিজ্ঞান বিভাগের ৩১ দশমিক ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। মোট শিক্ষার্থীর ৪৯ দশমিক ০৯ শতাংশই এবার ইংরেজিতে পাস করতে পারেনি। ১ লাখ ১৪ হাজার ২৮১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৭ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে গত বছরের অর্ধেকের কম ১ হাজার ৯২৭ জন। এমন ফল বিপর্যয় নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। কী কারণে ১১ বছর পর আবারও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হল যশোর বোর্ড সেটি নিয়ে শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মাধব চন্দ্র রুদ্র বলেন, ইংরেজি বিষয়ের কারণেই বোর্ডের সার্বিক ফলাফল খারাপ হয়েছে। ইংরেজিতে খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজবে শিক্ষার্থীরা ভুয়া প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে। যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নড়াইল জেলায় প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো। ওই সময় যশোরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আমরা অভিযান চালিয়েছিলাম। কিন্তু যশোর বোর্ডের কোনো প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। এবার লটারির মাধ্যমে প্রশ্ন নির্ধারণ হয়েছে। আমাদের বোর্ডের প্রশ্ন এবার কঠিন হয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা কোচিং ও গাইডমুখি হয়ে পড়ায় মূল বইয়ের দিকে নজর দেয় না। কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সাথে কথা বলে জেনেছি, এবার সিলেবাসের মধ্যেই মূল বই থেকে প্রশ্ন হয়েছে। কিন্তু কোচিং ও গাইডনির্ভরতায় এমন ফল বিপর্যয় হয়েছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আমীরুল আলম খান বলেন, ইংরেজিতে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন কঠিন হলে সে দায় যশোর বোর্ডের ওপর চাপানো যাবে না। তদন্ত হলেই বেরিয়ে আসবে দায় কার। কারণ, প্রশ্ন হয়েছিলো ৩২ সেট। তার মধ্য থেকে লটারিতে যশোর বোর্ড ৪ সেট প্রশ্ন পেয়েছে।

ইংরেজিতে ফল বিপর্যয় প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক কামরুল হাসান বলেন, গতানুগতিক ধারার বাইরে এবার উচ্চমানের প্রশ্ন হয়েছে। পরীক্ষায় গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাই বেশি। তাই নতুন কাঠামোগত প্রশ্নে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বেশি খারাপ করেছে। এতে করে সার্বিক ফলাফলে বিপর্যয় ঘটেছে।

যশোরের মুক্তিযোদ্ধা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আজিজুল হক বলেন, নতুন সিলেবাসে প্রথমবারের মতো এবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে ফল ভালো করতে পারেনি। নতুন সিলেবাসে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছিলো না। আবার নতুন সিলেবাসে অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বইয়ে বিস্তারিত নেই। নতুন বইও শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো পায়নি। এসব কারণেই মূলত পদার্থবিজ্ঞানে ফলাফল খারাপ হয়েছে বলে ধারণা করছি।

যশোর সদরের সিঙ্গিয়া আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান বলেন, ফলাফল খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ফেসবুক ও ইন্টারনেটে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব। শিক্ষার্থীরা ভুয়া প্রশ্ন সংগ্রহ করে পড়েছে। কিন্তু পরীক্ষায় সেই প্রশ্ন আসেনি। তাই কঠিন প্রশ্নে পরীক্ষার খাতায় তারা ঠিকমতো লিখতে পারেনি। এছাড়া নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরাও চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। অনেকে অকৃতকার্য হলেও মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র প্রতিপালন করতে গিয়ে শুধু ৭০ শতাংশ হাজিরার ভিত্তিতে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অনেককে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। অথচ তাদের অনেকে নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করেনি। একই সাথে বিগত বছরের অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা নির্বাচনী পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এসব কারণেও এবার ফলাফল খারাপ হতে পারে বলে ধারণা করছি।

এদিকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মাধব চন্দ্র রুদ্র আরও বলেন, ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান করতে জাতীয়ভাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখি করতে কলেজের অধ্যক্ষদের নিয়ে শিগগির বসবো। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করবো।