খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে বিএনপিতে বাড়ছে দুশ্চিন্তা

 

স্টাফ রিপোর্টার: খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচটি মামলা ঝুলছে। এর বাইরে নাশকতার একাধিক মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া তার ছোট ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর সোনালী ব্যাংকের ঋণখেলাপি মামলায়ও তাকে বিবাদী করার আদেশ দিয়েছেন আদালত বিএনপির লাগাতার অবরোধ চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যার ঘটনায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলায় অভিযোগপত্র দেয়ার পর ২ মাস না যেতেই এবার দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা সচল করেছে সরকার। একই সাথে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিচার কাজও দ্রুত গুটিয়ে আনছেন আদালত। পাশাপাশি দলের শীর্ষ স্থানীয় প্রায় এক ডজন নেতাকেও এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলার ফাঁদে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এতে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের আশঙ্কা, ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি দুর্নীতির মামলায়ও খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার ফন্দি এঁটেছে সরকার। আর এ নিয়ে যাতে রাজপথের আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে উঠতে না পারে এ জন্যই বিএনপির শীর্ষস্থানীয় অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দায়ের করা মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত গুটিয়ে এনে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবি, ৫ জানুয়ারির অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল ও দাতাগোষ্ঠীর চাপের মুখে রয়েছে। দেশে দ্রুত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দিতে তারা সরকারকে বিভিন্নভাবে তাগিদ দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার জামায়াতে ইসলামীর মতো বিএনপিকেও মামলা ফাঁদে ফেলে পুরোপুরি নিস্ক্রিয় করে দিয়ে নির্বাচন দিতে চাইছে। বিশেষ করে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যাতে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন, এ জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। এরই অংশ হিসেবে নতুন করে ফৌজদারি মামলা দেয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ ৭ বছর ধরে আদালতের ড্রিপ ফ্রিজে থাকা পুরনো মামলাগুলো সচল করে তাড়াহুড়ো করে বিচার কার্যক্রম শেষ করার পাঁয়তারা চলছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির নেতারা।

যদিও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতারই ধারণা, এসব কূটকৌশলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। তাদের ভাষ্য, মামলার চাপে হয়তো বিএনপি চেয়ারপারসনসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। তবে এই পরিস্থিতি খুব বেশি দীর্ঘায়িত হবে না। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনগণ সোচ্চার হলে এসব ষড়যন্ত্র খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে বলে মনে করেন তারা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিএনপিকে মামলা ফাঁদে ফেলে পুরোপুরি নিস্ক্রিয় করে রাখার ছক সরকার আটঘাট বেঁধেই তৈরি করেছে, যা কাটিয়ে আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠা বাস্তবিক অর্থেই বিএনপির জন্য কঠিন। পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকেরই দিনের সিংহভাগ সময় কাটছে মামলার ফাইল টানাটানিতেই। তাই তাদের নিজেদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে হতাশা। আর এ কারণেই দুই দফায় আন্দোলন চাঙ্গা হলেও সেটা সফল করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ৫টি মামলা ঝুলছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলাগুলো দায়ের করেছিল। মামলাগুলো হলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা এবং বড় পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা। এর বাইরে নাশকতার একাধিক মামলায় খালেদা জিয়াকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর সোনালী ব্যাংকের ঋণখেলাপি মামলায় খালেদা জিয়াকে বিবাদী করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।

এর মধ্যে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। এরই মধ্যে চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে বাদীকে জেরা করা শেষ হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এই মামলা দুটি যেভাবে চলছে, এতে দ্রুত এর কার্যক্রম শেষ হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

এদিকে বিএনপির লাগাতার হরতাল চলাকালে ২৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীর কাঠের পুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনের একটি বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। ১৯ মে ঢাকার সিএমএম আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করা হয়। এর আগে গত ৬ মে একই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের মামলায় খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে আরো একটি চার্জশিট দাখিল করে ডিবি। এই মামলায় খালেদা জিয়াসহ ৩১ জনকে পলাতক দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়।

বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় দেয়া চার্জশিটে খালেদা জিয়াকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তিনি ছাড়া উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বরকত উল্লাহ বুলু, আমান উল্লাহ আমান, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, শওকত মাহমুদ, বিশেষ সহকারী শামসুল ইসলাম শিমুল বিশ্বাস, প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান, মীর আবু জাফর শামসুদ্দিন দিদার, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী সপু, বিএনপির ঢাকা মহানগরের সদস্যসচিব হাবিব- উন-নবী খান সোহেল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আজিজুল বারী হেলাল, সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন আহমেদ, তার ছেলে তানভীর ওরফে রবিন, নবীউল্লাহ নবী, কাইয়ূম কমিশনার, লতিফ কমিশনার এবং পেশাজীবী দলের নেতা সেলিম ভুঁইয়া। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের অপর এসআই বশির আহমেদ।

গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে মামলা দুটি করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, সারাদেশে হাজার হাজার মামলা ঝুলে থাকলেও সরকার এ দুটি মামলার বিচার শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে মামলা দুটি অস্থায়ী আদালতে নিয়ে গেছে।

বুধবার বিকালে বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের নামে একাধিক মামলা চললেও সেটা ঝুলে আছে। অথচ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলাগুলো দ্রুত চালানো হচ্ছে। সপ্তার পর সপ্তাহ তারিখ দেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ওই ২ মামলায় বিচার চলছে। তারা চান, স্বাভাবিক গতিতে বিচার চলুক। তাড়াহুড়ো করে বিচার শেষ করে রায় দেয়া হবে ন্যক্কারজনক। এ দুটি মামলার বাইরে প্রায় ৭ বছর ধরে বাকি ৩টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত ছিলো। চলতি বছর মামলাগুলো সচল করার উদ্যোগ নেয় দুদক। উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, এখন নাইকো ও গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা চলতে বাধা নেই। অবশ্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, তারা আপিলে যাবেন। আর বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার আবেদন হাইকোর্টে বিচারাধীন।