জিন ছাড়াতে মা-বাবার হাতে প্রাণ গেলো সুমাইয়ার

স্টাফ রিপোর্টার: চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে জিনের আসর ছাড়াতে গিয়ে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে সুমাইয়াকে পিটিয়ে ও নির্যাতন মাধ্যমে হত্যা করেছেন মা-বাবা। গত মঙ্গলবার ভোররাতে উপজেলার মেহের উত্তর ইউনিয়নের তারাপুর কামারবাড়ি, যা সিরাজ মেম্বারের বাড়ি নামে পরিচিত, সেখানে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ এ ঘটনায় বাবা এমরান হোসেন ও মা আমেনা বেগমকে গ্রেফতার করেছে। গতকাল বুধবার আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠিয়েছেন।

এলাকার তিন-চারজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, মেম্বার বাড়ির কাঠমিস্ত্রি এমরান হোসেনের স্ত্রী আমেনা বেগম (৩৫) ৬-৭ দিন আগে নিজেকে জিনে ধরেছে বলে তার বাড়ির ও আশপাশের লোকজনকে জানান। বিষয়টি গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষ ওই বাড়িতে ভিড় জমায়। এরই মধ্যে ঝাড় ফুঁয়ের নামে গত ৩-৪ দিনে আশপাশের বাড়ির চারটি শিশুকে বেদম মারধর করেন আমেনা বেগম।

পুলিশ গ্রামবাসীর বরাত দিয়ে জানায়, এরই মধ্যে একটি মোবাইল সেট চুরির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় একই বাড়ির টাইলস শ্রমিক ইসমাইলকে সন্দেহ করা হয়। এরপর জিনের মাধ্যমে চোরকে ধরার জন্য গত শনিবার রাতে ইসমাইলকে ঘর থেকে ডেকে এনে মারধর করলে বিষয়টি নিয়ে এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকার লোকজন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে আমেনা তাদের লাঠি নিয়ে মারতে উদ্যত হন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে শাহরাস্তি মডেল থানার এসআই নিজামউদ্দিন জানান, সোমবার (৩ আগস্ট ) সকালে নিজ সন্তান সুমাইয়াকে জিনে ধরেছে উল্লেখ করে আমেনা শিশুটিকে মাটিতে রেখে তার ওপর চেপে বসেন ও বাবা গাছের ডাল দিয়ে মারতে শুরু করে। এ দৃশ্য দেখে আশপাশের লোকজন শিশুটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করলে তাঁদের ধাওয়া করা হয়। এরপর স্থানীয় লোকজন বিষয়টি পুলিশকে জানান।

গ্রামের বাসিন্দা কামরুজ্জামান সেন্টু জানান, পুলিশ আসার পর তিনি ও শিশুটির চাচাসহ কয়েকজন সুমাইয়াকে স্থানীয় বানিরয়ারচরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।

এসআই নিজাম আরও জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হলে আমেনা ও তার স্বামী এমরান উপস্থিত লোকজনের সামনে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন। ওই সময় এমরান পুলিশকে জানান, তারা গরিব ও বিভিন্ন এনজিও থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছেন। ওই ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে কোনো উপায় না পেয়ে তার স্ত্রী আমেনা বেগমের পরামর্শে এ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। পুলিশ তাদের কান ধরে উঠবস করায়। তারা আর এ রকম প্রতারণা করবেন না মর্মে পুলিশের কাছে ক্ষমা চাইলে পুলিশ স্থানীয়দের অনুরোধে ক্ষমা করে চলে আসে এবং শিশুটিকে তার নানির কাছে দিয়ে আসে। কিন্তু ওই দিনই (সোমবার) রাতে নানির কাছ থেকে সুমাইয়াকে নিয়ে আসেন তার বাবা-মা। রাত সাড়ে তিনটায় এই দম্পতি আবারও জিন তাড়ানোর নামে সাড়ে তিন বছরের সুমাইয়াকে নির্মম নির্যাতন করেন এবং ঘটনাস্থলে সুমাইয়ার মৃত্যু হয়। সকালে ওই দম্পতি ঘরের দরজা না খুললে বাড়ির লোকজনের সন্দেহ হয়। তারা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় দরজা খুলে শিশুটিকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। এ সময় সুমাইয়ার বাবা-মা পাশেই বসা ছিলেন। এরপর পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসে।

শাহরাস্তি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান জানান, থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে চাঁদপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে লাশ দাফন করা হয়। ওই দম্পতিকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করা হয়।

আদালত পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান জানান, চাঁদপুর বিচারিক হাকিম আদালত-১’র বিচারক তাসলিমা শারমিন ওই দম্পতির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে পাঠান।

ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ আগের দিন ওই দম্পতিকে ছেড়ে না দিলে হয়তো সুমাইয়া এমন নির্মমভাবে খুন হতো না। তবে এতে তিনি পুলিশকে দায়ী না করে সুমাইয়ার মা-বাবাকে দায়ী করেন। সহকারী পুলিশ সুপার (হাজিগঞ্জ সার্কেল) মো. আবু হানিফ বলেন, এখানে পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিলো না। খবর পেয়ে তারা ওই শিশুর সুস্থতার জন্য অন্য লোকজনের হাতে সুমাইয়াকে রেখে আসে এবং এলাকাবাসীর মাধ্যমে ওই দম্পতিকে বুঝিয়ে সাবধান করে আসে। কিন্তু এ ঘটনা কেন ঘটেছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।