চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দিনটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও অন্যতম স্মরণীয়

নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের দামুড়হুদার আটকবরে স্থানীয়

শহীদ দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালিত

 

damurhuda pic. 05.08.15 (7)

দামুড়হুদা প্রতিনিধি: দামুড়হুদায় যথাযথ মর্যাদায় স্থানীয় শহীদ দিবস পালিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এ দিনে দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহ আটকবর নামকস্থানে এলাকার ৮ বীর মুক্তিযোদ্ধা পাকহানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন। চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও স্মরণীয় হয়ে আছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রতিবছর এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়েছে।

গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় দামুড়হুদার আটকবরে পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে দিবসের কর্মসূচির সূচনা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুস, মুক্তিযুদ্ধের পতাকা উত্তোলন করেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের যুগ্মসম্পাদক মাহফুজুর রহমান সরকার এবং কালো পতাকা উত্তোলন করেন চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু হোসেন। পতাকা উত্তোলন শেষে আট শহীদ স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে প্রথমেই পুষ্পমাল্য অপর্ণ করা হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষে জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুস ও অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনজুমান আরা, দামুড়হুদা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ফরিদুর রহমান। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা আওয়ামী লীগ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, দামুড়হুদা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, জেলা আওয়ামী মহিলা লীগ, সদর উপজেলা পরিষদ, জেলা শ্রমিকলীগ, জেলা ছাত্রলীগ, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা ও চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আট শহীদ স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাসের সভাপতিত্বে জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক শওকত আলীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা ও স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদ প্রশাসক দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মনজু, চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র জেলা আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সী আলমগীর হান্নান, অ্যাড. শামসুজ্জোহা, প্রচার সম্পাদক ফেরদৌস আরা সুন্না, আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাড. আব্দুল মালেক, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু হোসেন, সাবেক জেলা কমান্ডার নূরুল ইসলাম মালিক, জীবননগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন, সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস শুকুর বাঙালী, দামুড়হুদা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আছির উদ্দিন, দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক নতিপোতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা খাঁন ও আলী আজগার ফটিক। উপস্থিত ছিলেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কোহিনুর বেগম, সাধারণ সম্পাদিকা মাহমুদা খাতুন পলি, জেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি আফজালুল হক, আলমডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক সোহরাব হোসেন, নতিপোতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল্লাহ বিশ্বাস, জেলা যুবলীগ নেতা আব্দুর রশিদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম, জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি রুবায়েত বিন আজাদ সুস্তির, সাধারণ সম্পাদক মোহাইমেন হাসান জোয়ার্দ্দার অনিক, কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানিম হাসান তারিক প্রমুখ। আলোচনাসভা শেষে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। দোয়া মাহফিল পরিচালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মাসুদুজ্জামান লিটু। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক শওকত আলী।

উল্লেখ্য,      ১৯৭১ সালের এ দিনে মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা প্রুপ কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী মহাজনপুর গ্রামের শেল্টার ক্যাম্পে অবস্থান করছিলো। ৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পার্শবর্তী বাগোয়ান গ্রামের মুসলিম লীগের দালাল কুবাদ খাঁকে ধরে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিলো। ৫ আগস্ট সকালে পাকিস্তানী দালার কুবাদ খাঁর দুজন লোক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এসে খবর দেয়, রাজাকাররা তাদের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য অস্ত্র নিয়ে আনুমানিক ২ কিলোমিটার দূরে বাগোয়ান গ্রামের মাঠে দক্ষিণ পশ্চিমে দু দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রেকি দল ফিরে আসার সাথে সাথে নাটুদহ ক্যাম্পের পাকসেনারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আখক্ষেতে ‘ইউ’ কাটিং অ্যাম্বুশ করে রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের অ্যাম্বুশে পড়ে যায়। এখানে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপি যুদ্ধ হয়। পাকহানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে হাসান জামান, সাইফুদ্দিন তারেক, রওশন আলম, আলাউল ইসলাম খোকন, আবুল কাশেম, রবিউল ইসলাম, কিয়ামুদ্দিন ও আফাজ উদ্দীন এ ৮ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেনের নির্দেশে নাটুদাহের এ স্থানে দুটি কবরে চারজন করে আটজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ পুতে রাখে। ওই আটজন মুক্তিযোদ্ধার কবরকে ঘিরেই এ স্থানটির নামকরণ করা হয় আটকবর। সে থেকেই চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের নেতৃত্বে প্রতিবছর এ দিনে এখানে স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৮ সালে এলজিইডি’র তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারি সহায়তায় ওই গণকবরের ওপর স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়। নাম দেয়া হয় আটকবর। পরবর্তীতে অর্থাৎ ২০১০ সালে হুইপ ছেলুনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে আট শহীদ বেদীর পাশেই গড়ে তোলা হয় দৃর্ষ্টিনন্দন আধুনিক আট শহীদ স্মৃতি কমপ্লেক্স। বর্তমানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ এ স্থানটি দেখতে আসেন। ফলে এ স্থানটি বর্তমানে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি লাভ করেছে।