স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটে নির্মম নিপীড়নে ১৩ বছরের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যা নিয়ে দেশজুড়ে এখনও তোলপাড় চলছে। এর মধ্যেই এবার খুলনায় পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়েছে ১২ বছরের এক শিশুকে। তার নাম মো. রাকিব। সোমবার রাতে নগরীর টুটপাড়ায় একটি মোটর গ্যারেজে মলদ্বারে পাইপের মাধ্যমে হাওয়া ঢুকিয়ে রাকিবকে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই স্থানীয় জনতা গ্যারেজ মালিক শরীফ (২৮), তার মা বিউটি বেগম (৫০) ও পাতানো চাচা মিন্টু মিয়াকে (৩৬) পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। রাকিবকে হত্যার ঘটনায় এ তিনজনকে আসামি করে মঙ্গলবার মামলা করেছেন শিশুটির বাবা। এদিন রাকিব হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে স্থানীয়রা প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে।
রাকিব টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের দিনমজুর মো. নূরুল আলমের ছেলে। সে টুটপাড়া কবরস্থানের কাছে শরীফের মোটরসাইকেল গ্যারেজ শরীফ মোটরসে কাজ করতো। রাকিবের স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, সেখানে ব্যাপক নির্যাতনের কারণে সাত মাস আগে সে ওই গ্যারেজ ছেড়ে পিটিআই মোড়ে আরেক গ্যারেজ নূর আলম মোটরসে কাজ নিয়েছিলো।
খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস বলেন, কাজ ছেড়ে দেয়ায় রাকিবের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলো শরীফ ও তার ঘনিষ্ঠ মিন্টু মিয়া। বিকালে গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে ডেকে নেয় মিন্টু। একপর্যায়ে শিশুটিকে বিবস্ত্র করে তার মলদ্বারে টায়ারে হাওয়া দেয়ার পাইপ ঢুকিয়ে দেয়। রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে-ফেঁপে ওঠে।
ওসি আরও জানান, রাকিব অসুস্থ হয়ে পড়লে শরীফ ও মিন্টু পেটে চাপ দিয়ে বাতাস বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শিশুটিকে প্রাইভেট ক্লিনিকে নেয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে রাকিবকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নেয়ার পথে রাকিব মারা যায়।
চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ওসি সুকুমার বলেন, রাকিবের শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে যায় ও ফুঁসফুঁস ফেটে যায়। এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে গেলে সে মারা যায়।
প্রতিবেশী জাহিদুর রহমান জাহিদ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সোমবার বিকালে রাকিব রঙ কেনার জন্য পিটিআই মোড় থেকে টুটপাড়া কবরস্থানে মোড়ের একটি দোকানে যায়। পাশেই ছিল শরীফের গ্যারেজ। সেখান থেকে মিন্টু রাকিবকে ধরে গ্যারেজে নেয়। এরপর জোর করে কাপড় খুলে তার মলদ্বারে কম্প্র্রেসারের পাইপ ঢুকিয়ে দেয়। এরপর মেশিন চালু করলে হাওয়ায় রাকিবের পেট ফুলতে শুরু করে। এ সময় শরীফ ও তার মা বিউটি বেগম জোর করে রাকিবকে ধরে রাখে। রাকিব যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকলেও তাতে মন গলেনি তাদের। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে মিন্টু রাকিবকে পাশের গুডহেলথ ক্লিনিকে নিয়ে যায়। পরে এলাকাবাসী রাকিবকে নিয়ে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
প্রতিবেশী মিজান হাওলাদার বলেন, সোমবার রাত ৯টার দিকে রাকিবের প্রায় নিথর দেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করা হয়। অ্যাম্বুলেন্সে তিনি রাকিবের মাথা কোলে নিয়ে বসা ছিলেন। বৈকালী এলাকা পার হতেই রাকিব শেষনিঃশ্বাষ ত্যাগ করে। এরপর লাশ নিয়ে তারা এলাকায় ফিরে আসেন এবং স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় গ্যারেজের মালিক শরীফ ও তার মা বিউটি বেগম এবং তাদের সঙ্গী মিন্টু মিয়াকে ধরে গণপিটুনি দেয়া হয়।
খুলনা সদর থানার এসআই তাপস কান্তি বলেন, রাকিব অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত টুটপাড়া মোড়ের গুডহেলথ ক্লিনিক, সেন্টমার্টিন ক্লিনিক, খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনা সর্জিক্যাল ক্লিনিক ও খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকায় নেয়ার পথে রাত সোয়া ৯টার দিকে রাকিব মারা যায়।
তাপস কান্তি আরও বলেন, খবর শুনে স্থানীয় লোকজন মোটরসাইকেল গ্যারেজের মালিক শরীফ, মা বিউটি ও চাচা মিন্টুকে গণপিটুনি দেয়। পুলিশ ৩ জনকে আহত অবস্থায় আটক করে খুমেক হাসপাতালে নেয়। মিন্টু ও শরীফকে পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়েছে। বিউটিকে থানাহাজতে রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় খুমেক হাসপাতালের মর্গে রাকিবের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। এরপর তার লাশ টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের বাসায় নেয়া হয়।
রাকিবের খালু খোকন শেখ বলেন, টুটপাড়ায় গোসল করানোর পর জানাজা শেষে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা সদরের রসুলপুরের উদ্দেশে রওনা হই আমরা। রাতে সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হবে।
রাকিব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কাজী মোস্তাক বলেন, ঘটনার পর সোমবার রাত থেকে বিক্ষোভের কারণে টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল নিয়ে টুটপাড়া কবরখানা মোড়ের শরীফের গ্যারেজের সামনে যায়। তারা ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় ১০ মিনিট সেখানে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। বেলা পৌনে ১২টার দিকে এলাকাবাসী টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের মাথায় মানববন্ধন করে। এ সময় প্রায় ঘণ্টাখানেক ওই সড়কেও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। তিনি বলেন, বিউটি বেগমকে মঙ্গলবার বিকালে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদনসহ আদালতে হাজির করা হয়। আর শরীফ ও মিন্টু হাসপাতালে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
টুটপাড়ার সেন্ট্রাল রোডের শওকতের বাড়িতে ভাড়া থাকেন রাকিবরা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শিশুকন্যা রিমিকে জড়িয়ে ধরে মা লাকি বেগম আর্তনাদ করছেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি পুত্র হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচার দাবি করেন। একমাত্র পুত্র রাকিবকে হারিয়ে বাবা নূরুল আলমও পাগল প্রায়। ভাইয়ের জন্য কান্নায় বুক ফাটাচ্ছিল ছোট বোনও।
তক্ষীরায় অভাবের সংসার চালাতে না পেরে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বছরতিনেক আগে খুলনায় আসেন নূরুল আলম। কিন্তু অভাব পিছু ছাড়েনি তার। বাধ্য হয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়ই বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে গ্যারেজে কাজ নিতে হয় রাকিবকে। কিন্তু সেখানেও বরাবরই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতো এ শিশু। শেষ পর্যন্ত নির্যাতনেই প্রাণ হারাল সে।
আজ মানববন্ধন: নির্মম নির্যাতনে শিশু রাকিবকে হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে নাগরিক সমাজ। এ হত্যার বিচার দাবিতে জনউদ্যোগ ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার আহ্বানে আজ বেলা ১১টায় মহানগরীর পিকচার প্যালেস মোড়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে খুলনা জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রসু আক্তার বলেছেন, শিশু রাকিব হত্যার সুষ্ঠু বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে দেয়া হবে।
শিশু রাকিব হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) নেতারা। বিবৃতিদাতারা হলেন- ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এলিনা খান, খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি মো. খবিরুজ্জামান, জেলা শাখার সভাপতি অ্যাভোকেট ড. স ম বাবর আলী, ফরিদ আহমেদ, মিজানুর রহমান মিল্টন, সাহারা ইরানী পিয়া, গোলাম কিবরিয়া তুহিন প্রমুখ। বিবৃতিতে নেতারা রাকিবকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।