ছিটমহলের মানুষের জীবন শঙ্কামুক্ত ও সচ্ছল হোক

শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিট, যখন ক্যালেন্ডারে তারিখ ১ আগস্ট, ১৬২টি ছিটমহলের বাড়িতে বাড়িতে জ্বলে উঠলো ৬৮টি করে মোমবাতি। বদলে গেলো পতাকা, বদলে গেলো পরিচয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো। নতুন জীবনে প্রবেশ করেছে ৫০ হাজার মানুষ। ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০.৬৩ একর আয়তনের ভারতের ১১১টি ছিটমহল মিশে গেলো বাংলাদেশের সাথে। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে থাকা ৭ হাজার ১১০.০২৫ একর আয়তনের ৫১টি ছিটমহল ভারতের মানচিত্রে মিলে গেছে। দীর্ঘ অমীমাংসিত এ সমস্যা অবসানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র পূর্ণতা পাওয়ার পথে এগিয়ে গেছে আরো এক ধাপ। এতোদিন যে ছিটমহলের মালিক ছিলো ভারত সেখানে উড়েছে বাংলাদেশের পতাকা। ভারতের পতাকা উড়েছে বাংলাদেশের মালিকানায় থাকা ছিটমহলগুলোতে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানকালে দেশভাগের সময় ৱ্যাডক্লিফ কমিশনের চিহ্নিত করা সীমান্তে যে ছিটমহল জটিলতার শুরু, তার অবসান হয়ে গেলো। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এ সমস্যা অবসান করতে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত হয় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। সে চুক্তি কার্যকর করতে প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয় ২০১১ সালে।

ছিটমহল নামের বাংলাদেশ-ভারত দু দেশের মানচিত্রের মধ্যে জ্বলজ্বল করা কলঙ্কতিলক মুছে যাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহেই ইতিবাচক। লাখো মানুষের গত ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের অবসান হওয়াকে আমরা স্বাগত জানাই। যখন এ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে, তখন ছিটমহল অধিবাসীদের ক্ষেত্রে পরবর্তী পদক্ষেপগুলোও যেন যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়, সেদিকে সরকারের আন্তরিকভাবে লক্ষ্য রাখা জরুরি। এ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলেও ছিটমহলের অধিবাসীরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে চাইলে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে যেন কোনো ভোগান্তি না হয় সেদিকেও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ১১১টি ছিটমহলে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকার ইচ্ছা পোষণকারীরা ছাড়া অন্য বাসিন্দাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হচ্ছে। আর ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও শুক্রবার মধ্যরাত থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে সেখানকার নাগরিকরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যাশা করি, নাগরিকত্ব দেয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ সরকার তাদের সামগ্রিক অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মনে রাখতে হবে যে, যেহেতু তারা এক ধরনের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হচ্ছে, ফলে শিক্ষাসহ সার্বিকভাবে মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে কোনো প্রকার গড়িমসি যেন হয় তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। প্রয়োজনে সরকারকে যথাযথভাবে মনিটরিং করতে হবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্থলসীমান্তচুক্তি সই হয়েছিলো। যেখানে বাংলাদেশ ওই সময়ই চুক্তিটি অভ্যন্তরীণভাবে অনুমোদন বা অনুসমর্থন করে। কিন্তু ভারত ওই সময় তা অনুসমর্থন না করার ফলে চুক্তির বাস্তবায়ন আটকে যায়। এরপর নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় এলে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ‘স্থলসীমান্ত’ বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশভাবে পাস হয়। যা ছিটমহলবাসীদের জন্য ছিলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মূলত ভারতীয় পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশভাবে পাস হওয়ার মধ্যদিয়েই ১৬২টি ছিটমহলবাসীর ভাগ্যের দরজা খুলে যায়। ৬ থেকে ১৬ জুলাই যৌথ হালনাগাদ কার্যক্রমসহ বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া পরিচালনার পর সরকারি সব আনুষ্ঠানিকতা শেষেই এ ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা দু দেশের সুসম্পর্ককে আরো দৃঢ় করবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। এখন সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ হলেও যারা বাংলাদেশের নাগরিত্ব গ্রহণ করলো তাদের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি যা বলাই বাহুল্য। নানা ধরনের অবহেলা ও বঞ্চনার অধ্যায় শেষে এখন তারা যেন যথাযথ সুরক্ষা ও নায্য অধিকার পায় সেদিকে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। এটা ভুলে যাওয়া যাবে না যে, ছিটমহলবাসীরা যখন স্বাধীন ভূখণ্ড পাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই তাদের চোখে-মুখে নতুন স্বপ্ন। আমরা চাই, জীবনকে অর্থময় ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করাসহ তাদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়েও সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। এছাড়া যথাযথ পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে বিদ্যমান অবস্থা থেকে তাদের যথাযথ অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সরকার আন্তরিক হোক। ভারত গমনেচ্ছুরা প্রধানত পরিবারগুলোর ভারতে বসবাস করা আত্মীয়-স্বজন, ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আর্কষণীয় প্যাকেজে প্রলুব্ধ হওয়া, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা এবং ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তারা ভারতেই থাকতে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, যারা বাংলাদেশে থাকছেন তাদের পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে সরকার কর্মসংস্থান, নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে দ্বিধা করবে না।

মানুষ স্বপ্ন দেখে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের পরিচয়হীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে যারা নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে, তাদের মনেও স্বপ্ন আছে। রক্তপাতহীনভাবে দুটি দেশের মানচিত্রে পরিবর্তন হয়েছে। এ শান্তি যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেদিকে রাষ্ট্রকে দৃষ্টি দিতে হবে। এতোদিন বঞ্চনা সয়ে আসা মানুষগুলোকে নতুন জীবনে স্বাগত জানিয়ে তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে সব মৌলিক অধিকার। তাদের ভূখণ্ডের মালিকানার পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা অতিদ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন কোনো মানসিক দৈন্যের মুখে না পড়ে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। নতুন ঠিকানা পাওয়া ছিটমহলের মানুষের জীবন শঙ্কামুক্ত ও সচ্ছল হোক।