তরিকুলের অসুস্থতায় এগোতে পারছে না বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যশোর বিএনপির সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। কিন্তু গত কয়েক বছরে শারীরিক অসুস্থতায় রাজপথে তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারছেন না তিনি। বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে সময় পার করছেন যশোর বিএনপির মুকুট বলে পরিচিত তরিকুল ইসলাম। নিজের অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব দিতে রাজনীতির মাঠে নামিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের। জেলায় বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, মাঠপর্যায়ে ব্যাপক সমর্থন থাকার পরও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এ জেলায় বিএনপি সেভাবে এগোতে পারছে না। মূলত তরিকুল ইসলাম শয্যাশায়ী হওয়ায় জেলার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এদিকে দলীয় সূত্রগুলো বলছে, যশোর বিএনপি ছাড়াও তরিকুল ইসলাম কেন্দ্রের একজন প্রভাবশালী নেতা। এ জন্য সরকারি দল যশোরে শুধু বিএনপি ঠেকাও কৌশল প্রয়োগ করছে না। শুরু থেকেই তরিকুল ইসলামের ওপর একের এক মামলার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এছাড়া টানা অবরোধ আন্দোলনের শুরুতেই নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দিতে তাদের ওপর সমানে মামলা-হামলা চালানো হয়। গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। যারা রাজপথে নামার চেষ্টা করেন তাদের অনেকেই হন গ্রেফতার। এমন পরিস্থিতিতে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে সৃষ্টি হয় আতংক। একপর্যায়ে সিনিয়র নেতাদের অনুপস্থিতিতে কর্মীরাও রাজপথে নামতে সাহস পাননি। আবার জেলা ও উপজেলা নেতাদের কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে গা বাঁচিয়ে চলার অভিযোগ। তা সত্ত্বেও গত রমজানে ইফতার রাজনীতির মধ্যদিয়ে যশোর বিএনপি কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাবেরুল হক সাবু বলেন, বলতে গেলে আমরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি। যশোরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে মনে হয় তারা বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। বিগত আন্দোলনে অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা এবং অনেককে গ্রেফতার করা হয়। কেউ জামিন পেলে জেলগেট থেকে তাকে ফের আটক করে নিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে ভাঙচুর চালায়। এমনকি রাজপথে না নামতে নানা ধরনের হুমকিও দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, এসব হুমকি এবং ভয়ভীতি উপক্ষো করেও নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকার চেষ্টা করছেন। তারা এখনও অনেকটা সুসংগঠিত। গত ইফতার মাহফিলে তাদের উপস্থিতি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এমন দুচারজন হয়তো থাকতে পারেন।

দলীয় সূত্র জানায়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তরিকুল ইসলামের কথাই ছিলো শেষ কথা। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে সদর আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তরিকুল ইসলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একবারই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রী হয়েছেন বহুবার। দলের প্রভাবশালী এ নেতা যশোর তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিএনপিতে বড় ফ্যাক্টর অনেক আগে থেকেই। তাকে বিক্ষুব্ধ করে কেউ দলে টিকে থাকতে পারেননি। তরিকুল ইসলামের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাবেক দফতর সম্পাদক শার্শার মফিকুল হাসান তৃপ্তি রাজনীতি শুরু করেন। হাওয়া ভবনের প্রভাব দেখিয়ে তরিকুলের বিকল্প হওয়ার চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু তরিকুলের সঙ্গে টেক্কা দিতে গিয়ে দল থেকে ছিটকে পড়েন তৃপ্তি। একপর্যায়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। তৃপ্তির দল থেকে বহিষ্কারের পেছনে তরিকুল ইসলামের মুখ্য ভূমিকা ছিলো বলে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন আছে। তরিকুল ইসলামের বিকল্প হতে গিয়ে মফিকুল হাসান তৃপ্তি এখনও দলে ফিরতে পারেননি। জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মনিরুল হুদাও বিএনপির রাজনীতিতে অনেকটা নির্বাসিত। তরিকুল ইসলামের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তাকে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। দলের তরিকুল সমালোচকদের মুখে এমন অনেক মন্তব্য শোনা যায়। তবে তারা এও বলেন, তরিকুল ভাই আমাদের পরীক্ষিত নেতা। লিডার ছাড়া যশোরে বিএনপির সাফল্য ভাবাই যায় না।

জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, বিগত জোট সরকারের সময় যশোর এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়। এ উন্নয়নের আড়ালে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মেরও অভিযোগ ছিল। তরিকুল ইসলামের চেয়ে তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ছিল বেশি। তরিকুল ইসলামের স্ত্রী অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম ও ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। তাই বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করে। ওই মামলায় তরিকুল ইসলাম গ্রেফতারও হন।

জেলা বিএনপির সভাপতি চৌধুরী শহিদুল ইসলাম নয়নের মৃত্যুর পর তরিকুল ইসলামের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত সহসভাপতি শামসুল হুদাকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হুদা ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুর নেতৃত্বাধীন কমিটির নির্দেশনায় চলছে বিএনপি। তরিকুলের স্ত্রী নার্গিস বেগম ও ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত জেলা বিএনপির সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলেও সবকিছুই চলে তাদের ছক অনুসারে। পরিবারের বাইরে কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন না। তরিকুল ইসলামের ভাইপো পৌর মেয়র নগর বিএনপির সভাপতি মারুফুল ইসলাম মারুফ। তিনিও চাচার প্রভাবে নিজেকে অনেকখানি এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

সূত্র জানায়, এক সময় তরিকুলই রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসেন তার ভাইপো মারুফকে। তার অনুপস্থিতিতে দলের প্রায় সবকিছুই করতেন মারুফ। পরে তরিকুলের ছেলে অমিতকেই রাজনীতির মাঠে নামানো হয়। মারুফ ও অমিত প্রকাশ্যে একই ধারায় রাজনীতি করলেও উভয়েরই নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। তবে তরিকুলের অনুপস্থিতিতে বর্তমানে জেলার রাজনীতি অমিতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বললেও ভুল বলা হবে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলার একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, বাবার যোগ্য উত্তরসুরি হওয়ার মতো যোগ্যতা এখনও তৈরি করতে পারেননি অমিত। তার কিছু কিছু কর্মকাণ্ডে নেতাকর্মীরাও অসন্তুষ্ট। তরিকুল ইসলাম সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করার যে যোগ্যতা অর্জন করেছেন অমিত সেক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে। তাকে তার বাবার মতো আরও ধীরস্থির ও ঠাণ্ডা মাথায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পরামর্শ দেন তারা। তবে অমিতের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, তিনি এখনও বয়সে তরুণ। জেলার নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা সবাই তার বাবার সঙ্গে রাজনীতি করেন। তাই তাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সময় লাগবে।

নেতাকর্মীদের অভিযোগ, জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার অনেক নেতা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আঁতাত করে নিরাপদে আছেন। চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি জহুরুল ইসলাম, পৌর মেয়র সেলিম রেজা আউলিয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে নিরাপদেই আছেন। হামলা-মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউনুস আলী। দলীয় কর্মসূচি পালন ও দলের সক্রিয় নেতা হিসেবে ইউনুস আলী তৎপর রয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে ইউনুস আলী বলেন, অসংখ্য মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের জেলে পুরে সরকার আন্দোলন দমানোর কৌশল নিয়েছে। আন্দোলনের শুরুতেই অনেককে গ্রেফতার করা হয়। তারপরও আমরা রাজপথে ছিলাম এবং এখানও আছি। কিন্তু উপজেলা সভাপতি জহুরুল ইসলামসহ অনেকেই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত আছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তরিকুল ইসলামের অসুস্থতা জেলার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব পড়েছে জানিয়ে এ নেতা বলেন, তিনি কেন্দ্রীয় নেতা হলেও জেলার অভিভাবক। অভিভাবক ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে পরিবারের ওপর তো তার প্রভাব পড়বেই। আল্লাহ না করুক কোনো কারণে তরিকুলের কিছু হলে শুধু যশোর নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থায় ব্যাপক প্রভাব পড়বে।

ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির নেত্রী উপজেলা চেয়ারম্যান সাবিরা নাজমুল এবং বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মর্তুজা এলাহি টিপুর বিরুদ্ধেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ রয়েছে। এ সুবাদে তারা রাজনৈতিকভাবে হয়রানি থেকে মুক্ত রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এ উপজেলায় বিএনপি জোটের ভোটের অভাব নেই। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এখানে বিএনপি দাঁড়াতেই পারছে না। বেশ কিছু নেতার এমপি প্রার্থী হওয়ার মতো সক্ষমতা থাকলেও তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও খাই খাই স্বভাবের কারণে তারা বড় নেতা হতে পারেননি। যে কারণে এ আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা কয়েক দফা এমপি হয়েছেন, যা স্থানীয় বিএনপির জন্য দুর্ভাগ্য বলেও মন্তব্য করেন তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীরা।

শার্শা উপজেলা বিএনপির নেতা খায়রুজ্জামান মধু ও জহির ইকবালসহ অনেকের বিরুদ্ধেই সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ রয়েছে। মণিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শহীদ ইকবাল হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একাধিক নাশকতার মামলায় তিনি জেল খেটেছেন। দলের সক্রিয় নেতা হিসেবে মণিরামপুরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অসংখ্য মামলায় জড়িয়েছেন নিজেকে।

বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে তিন মাস জেলও খেটেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টিএস আইয়ুব বলেন, সরকার যেভাবে মামলা হামলা করেছে তাতে টিকে থাকাই কঠিন। তারপরও সবকিছু মোকাবেলা করে নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকার চেষ্টা করছেন। তিনি জানান, কয়েক মাস আগে শেষ হওয়া আন্দোলনের পর আবারও সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এখনও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নানাভাবে নেতাকর্মীদের হয়রানি করছে। এর মধ্যেও কেন্দ্র ঘোষিত নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। আইয়ুব দাবি করেন, জেলা বিএনপিতে প্রকাশ্যে কোনো গ্রুপিং নেই। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে হয়তো কারও মাঝে মান-অভিমান থাকতেই পারে।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে অভয়নগরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ফারাজি মতিয়ার রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতা গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আসামি হয়েছেন। হামলা-মামলায় জর্জরিত অভয়নগর বিএনপিও। কেশবপুরে পৌর মেয়র আবদুস সামাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আঁতাতের অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির অধিকাংশ নেতা এখন শুধু আঁতাতের রাজনীতি করছেন।

Leave a comment