দরিদ্র মত্স্যজীবী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘উইঙ্গস অব ফায়ার’ পড়লে মনে হবে যেন রূপকথার অতিকল্পাশ্রিত কোনো কাহিনি! স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রোজগারের তাগিদে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হয়েছে শিশু কালামকে। পদার্থবিদ্যা ও পরবর্তীতে এয়ারোসেপস ইঞ্জিনিয়ারিঙের ওপর পড়ার সময় তার স্বপ্ন ছিলো ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানচালক হওয়ার। তার ক্লাসের প্রথম আটজনই বিমানবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য নির্বাচিত হলেও তিনি হন ৯ম। ফলে বিমানচালক হওয়ার স্বপ্ন অধরা থেকে গেলো। তাই বলে থেমে যেতে হবে? না, থামেননি তিনি। তিনি একসময় নিজের অদম্য চেষ্টায় ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’ হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধাস্ত্রের নতুন নতুন আধুনিকায়ন কিংবা পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বকে আরও বেশি অস্থিতিশীল করছে বলে মনে করেন শান্তি বা মানবতার কেতনধারী মহামানবেরা। এপিজে আবদুল কালামও ছিলেন মানবতার এক মহানপুরুষ। পৃথিবীর প্রথম পরমাণু বোমার বিস্ফোরণের তীব্রতা দেখে এর জনক বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারকে আমৃত্যু তাড়া করে বেড়িয়েছে তার সৃষ্টির ভয়াবহতা। ১৯৯৮ সালে ভারতের রাজস্থানের পোখরানের মরুভূমিতে পারমাণবিক সফল ধ্বংসাস্ত্র পরীক্ষার পর কী অনুভূতি হয়েছে তার নেপথ্যনায়ক এপিজে আবদুল কালামের? নিজের সৃষ্টির বীভত্সতা কি তাকে আহত করেছে? নাকি আপাদমস্তক মানবিক মানুষটি ভেবেছিলেন- শান্তির জন্যও শক্তিধর হওয়ার বিকল্প নেই? পরবর্তীতে ভারতের গর্বের অগ্নি ও পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির আড়ালেও তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তার নিরন্তর গবেষণায় ভারতের অস্ত্রের ধার ও ভার উত্তরোত্তর বাড়লেও পৃথিবীর কাছে তিনি সমধিক পরিচিত তার শিশুর সারল্যমাখা হাসি আর নিয়মভাঙা স্বভাবের জন্য। ২০০২ সালে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ও বিরোধী পক্ষের সর্বসম্মত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হন এপিজে আবদুল কালাম। গুজরাট দাঙ্গার ক্ষত তখনও থকথকে ছিলো, এমন সময় ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন দরবেশতুল্য মানুষকে রাষ্ট্রপতি করাটা তাত্পর্যপূর্ণ ছিলো বটে। আর রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশের পর তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের ‘পিপলস প্রেসিডেন্ট।’ তার আমলেই রাইসিনা হিলসের মুঘল গার্ডেন ভরে উঠতো শিশুদের হাসিতে। রাষ্ট্রপতিকে যে চিঠি লেখা যায় এবং সেই চিঠির উত্তরও আসে- এমন বিস্ময়ের প্রথম কারিগর তিনিই। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি পুনরায় ফেরেন পড়াশোনার জগতে। এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বক্তৃতার সময় মঞ্চেই তার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়াটা তাই এক আশ্চর্য সমাপতন বটে!
‘সূর্যের মতো উজ্জ্বল হতে হলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে হবে।’ তার এ বাণীর মতোই নিজেকেও তিনি পুড়িয়ে খাঁটি ও উজ্জ্বল করেছেন। গত সোমবার দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেয়া এ আপাদমস্তক মানবতাবাদী ও বিদ্যানুরাগী মানুষটি ৮৪ বছর বয়সে চিরতরে বিদায় নিলেন পূর্ব ভারতের এক পাহাড়ি শহরে। এ সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানবতাবাদী মানুষের বিদেহী আত্মার প্রতি আমরাও জানাই, শোক ও শ্রদ্ধা। তিনি শান্তিতে চিরশায়িত থাকুন। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজে মানবতাবাদী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। যেখানে যতো সঙ্কীর্ণ পরিবেশেই জন্ম হোক, অদম্য ইচ্ছে আর নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে বাস্তবায়ন যে অসম্ভব নয়, তা তিনি নানাভাবেই প্রমাণ করেছেন। তার রেখে যাওয়া জীবনচিত্র, অদম্য অগ্রযাত্রা হোক সম্ভাবনাময়ী সকলের প্রেরণা।