ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই এমপি রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি কাজী কেরামত আলীর সংবাদ সম্মেলন
স্টাফ রিপোর্টার: পুলিশের ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে ঘুষ লেনদেনসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ আমলে না নিয়েই তাদের প্রশিক্ষণে পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাছাই হওয়া ১০ হাজার কনস্টেবলের মধ্যে ৯ হাজার ৩৭৩ জন ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণে যোগ দিয়েছেন। দেশের ১৬টি পুলিশ ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে আরও এক হাজারের বেশি সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) নিয়োগ প্রক্রিয়া। গতকাল সোমবার দেশের সাতটি বিভাগীয় সদরে একযোগে এসআই পদে নিয়োগ পেতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের প্রাথমিক বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। প্রাথমিক বাছাই ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের লিখিত পরীক্ষা হবে ৭ থেকে ৯ আগস্ট। এছাড়া আগামী মাসেই কনস্টেবলসহ আরও ১০ হাজার পুলিশ সদস্য নেয়া হবে বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে।
কনস্টেবল নিয়োগের মতো এসআই পদে নিয়োগেও বড় ধরনের ঘুষ বাণিজ্যের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল সোমবার পরীক্ষা দিতে আসা অনেক প্রার্থীও এ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম দামপাড়া পুলিশ লাইনে শারীরিক পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা প্রার্থী সাত্তার মোল্লা বলেন, ফেনী থেকে রোববার রাতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে পরীক্ষা দিতে এসেছি। এখানে এসে শুনি নিয়োগের তালিকা নাকি আগেই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আরেক প্রার্থীকে মোবাইলফোনে বলতে শোনা যায়, স্যার আপনাকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছি। আরও ৫ লাখ কয়েক দিনের মধ্যেই দিয়ে দিবো। আমার চাকরিটা যাতে হয়। আমি এখন পুলিশ লাইনের সামনে। এ বিষয়ে ওই প্রার্থীর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি। অপর এক পরীক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি খুব সকালে দামপাড়া পুলিশ লাইনের সামনে যাই। ৯টার আগে যেতে হবে, তাই তাড়াহুড়ো করে সেখানে গিয়ে দেখি অর্থ লেনদেনের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। আমি রাঙ্গামাটি থেকে এসেছি। সেখানেও আমাকে একজন এ প্রলোভন দেখায়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার রাতে বলেন, পুলিশে জনবল নিয়োগ চলমান প্রক্রিয়া। কারও মুখ দেখে কিংবা সুপারিশের ভিত্তিতে পুলিশে নিয়োগ হচ্ছে না। পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতেই এ নিয়োগ চলছে। এর আগে কনস্টেবল নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পরও তা আমলে নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণে পাঠানোর বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অভিযোগের তদন্ত হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যোগ্য প্রার্থীরা ট্রেনিংয়ে চলে গেছেন। এ বিষয়ে আর কোনো অভিযোগ নেই। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৬৪ জেলায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাড়ে আট হাজার পুরুষ ও দেড় হাজার নারী কনস্টেবল নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৯ হাজার ৩৭৩ জন প্রশিক্ষণের জন্য যোগ দিয়েছেন। দেশের ১৬টি পুলিশ প্রশিক্ষণ ইন্সটিউটে তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে তাদের কনস্টেবল হিসেবে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হবে।
বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে একসাথে সর্ববৃহৎ এ নিয়োগে বড় ধরনের ঘুষ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠে। এর মধ্যে রয়েছে- এক জেলার প্রার্থী নেয়া হয় অন্য জেলা থেকে। এছাড়া ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ করেন রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওসহ বেশ কয়েকটি জেলার সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতারা। অভিযোগ যায় সংসদীয় কমিটিতেও।
গত মার্চে রাজবাড়ি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি কাজী কেরামত আলী ও সংরক্ষিত আসনের এমপি কামরুন্নাহার চৌধুরী লাভলী কনস্টেবল নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করেন। এছাড়া এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা জেলা কোটায় নিয়োগ পাওয়া ৫৯২ জনের মধ্যে ৫৮১ জনই দেশের অন্য জেলার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বাসিন্দাই বেশি। ধামরাই, সাভার ও কেরাণীগঞ্জের ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নিয়োগ পান তারা। ঢাকা জেলা কোটায় কনস্টেবল পদে কেরাণীগঞ্জের চরকুণ্ডুলিয়া গ্রাম থেকে পুলিশে নিয়োগ পান ১৮৬ জন। সরেজমিন চরকুণ্ডুলিয়া গ্রামটি ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই গ্রামে ২শ’ পরিবারে জনসংখ্যা মাত্র ৫শ। একসঙ্গে এত লোকের চাকরি হলে তা সবার মুখে-মুখে থাকতো। উল্টো কেউ এ খবরই জানেন না। নিয়োগ প্রাপ্তদের তালিকায় থাকা একজন কনস্টেবলও ওই গ্রামের বাসিন্দা নন। এমনকি পুলিশে নিয়োগ পাওয়া একজনকেও চেনেন না গ্রামের বাসিন্দারা। চরকুণ্ডুলিয়ার মতো ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা দেখিয়ে ৩৯৫ যুবক এ বছর পুলিশে নিয়োগ পেয়েছেন। সরেজমিন দেখা যায়, ধামরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম নান্দাইল। ওই গ্রামের পরিবার সংখ্যা প্রায় আড়াইশ। জনসংখ্যা মাত্র হাজারখানেক। শুধু নান্দাইল গ্রামের বাসিন্দা দেখিয়ে এ মৌসুমে পুলিশে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ৩০০ জন কনস্টেবল। কিন্তু তারা কেউ এলাকার ভোটার নন। ভোটার তালিকায়ও তাদের কারও নাম নেই। স্থানীয় বাসিন্দারাও কেউ তাদের চেনেন না। চেনেন না জনপ্রতিনিধি কিংবা গ্রামের বয়োবৃদ্ধরাও। পুলিশে চাকরি পেতে দেশের বিভিন্ন জেলার তরুণরা এ ধরনের মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার ও প্রতারণার আশ্রয় নেন। আর এ মিথ্যাচারের বিষয়টি খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাও জানেন। অভিযোগ রয়েছে, জেনেশুনেই এবং ঊর্ধ্বতন অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য আবদুল হাই ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে। কনস্টেবল নিয়োগে ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার আবদুর রহিম শাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলাম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের গোলাম মোস্তফা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের আবদুল ওদুদ বিশ্বাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৮ মার্চ লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, ১৭ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দেয়া হয়। জেলা পুলিশ সুপার ছয়-সাত লাখ টাকা করে নিয়ে জামায়াত ও বিএনপির লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন।
এক হাজার এসআই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু: পুলিশে নতুন করে এক হাজার সাব-ইন্সপেক্টর বা এসআই নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার দেশের সাতটি বিভাগীয় সদরে একযোগে বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের আগামী ৭ থেকে ৯ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। পুলিশ সদর দফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক হাজার এসআই নিয়োগ দেয়া হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে বেশ কিছুদিন সময় প্রয়োজন। ওই সময়ে আরও শূন্য পদ থাকলে ওইসব পদেও জনবল নিয়োগ দেয়া হবে। সব মিলিয়ে এ দফায় এক হাজার থেকে ১১শর মতো এসআই নিয়োগ দেয়া হবে।
আগামী মাসেই আরও ১০ হাজার নিয়োগ: এদিকে আগামী মাসেই আরও ১০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে। পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে নতুন ৫০ হাজার সদস্য নিয়োগের অংশ হিসেবে তৃতীয় ধাপে এ ১০ হাজার সদস্য নিয়োগ দেয়া হবে। পুলিশ বাহিনীতে সব মিলিয়ে বর্তমানে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৯ জন সদস্য রয়েছেন।