সাম্য ও সৌহার্দ্যের প্রতীক ঈদ- প্রফেসর মুহাম্মদ ইউসুফ আলী

 

‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ হাঁ ঈদ মানেই আনন্দ আর খুশির বার্তা। কবির ভাষায়, ‘আজ ঈদগাহে নেমেছে নতুন দিন, চিত্তের ধনে সকলে বিত্তবান, বড়-ছোট নাই, ভেদাভেদ নাই কোনো, সকলে সমান, সকলে মহীয়ান।’ বাস্তবিক পক্ষেই ধনী-গরিব, শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক, প্রৌঢ়-বৃদ্ধ; এক কথায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের মাঝেই অনাবিল আনন্দের ঢেউ তোলে এই ঈদ। উৎসবের আনন্দধারা সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়াই এই পবিত্র দিনের মর্মকথা। ঈদের ময়দানে রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, শাদা-কালো কোনো ভেদাভেদ নেই। এ যেন কবির সেই বাণীকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘ধনী-গরিব নেই ভেদাভেদ, সমান সবে আজি/আজ মিলনের বেহেশতি সূর, উঠছে সদা বাজি।’ প্রকৃত অর্থেই সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা দিয়ে যায় ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে আনন্দের দিন, আর এটি হচ্ছে আমাদের আনন্দের দিন। যারা রোজা রাখেনি তাদের জন্য এ দিনে আনন্দের কিছু নেই। মাসের প্রথমে বেতন পাওয়ার আনন্দ তো তারাই প্রকৃতপক্ষে লাভ করতে পারে যারা দীর্ঘ এক মাস কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অফিসের কাজ সম্পন্ন করে অথবা নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। ঈদের দিন হলো রোজাদারদের জন্য পুরস্কার বা বেতন পাওয়ার দিন। বিশ্ব নবী (সাঃ) এরশাদ করেন, ঈদের দিন হলো রোজাদারদের পুরস্কারের দিন এবং আসমানে এ দিনকে পুরস্কার দিবস বলে নামকরণ করা হয় (তাবারানি)। তবে আল্লাহ তায়ালার অপার মেহেরবানি তিনি অঢেল বোনাসসহ বান্দার কর্মের পুরস্কার দিয়ে থাকেন। আল্লাহপাকের ঘোষণা, প্রত্যেক নেক কাজের বদলা আমি দশগুণ দিয়ে থাকি। যাকে ইচ্ছা আমি আরও অঢেল বাড়িয়ে দিই (আল কোরআন)। এই পুরস্কার অন্য মাসের জন্য। রোজা ও ঈদ উপলক্ষে আল্লাহপাক যে কি পরিমাণ দান করেন তা তিনি ছাড়া কেউই জানে না। ঈদ মানে আনন্দ হলেও, এটি আনন্দ আর ফূর্তি নয়; নিষ্কলুষ আনন্দ আর ইবাদতের এক অপূর্ব মিলনের নাম ঈদ। এই কারণে ঈদের উৎসবও ইবাদতের আদল বা মেজাজেই করতে হবে। শুধূ নাজায়েজ হাঁসি তামাশা আর আমোদ ফূর্তিতে যাতে ঈদের সময়টুকু না কাটে সে দিকেও খেয়াল রাখা দরকার। ঈদ যেমন আনন্দ তেমনি ইবাদতও বটে। এ কারণে ঈদেরও কিছু সুন্নত তরিকা আছে। এর সুন্নত তরিকাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ঈদের নামাজের আগে গোসল করে নেয়া, ভালো পোশাক পরিধান করা, আতর-সুগন্ধি মেখে ঈদগায় যাওয়া, সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হলে তা নামাজের আগেই আদায় করে দেয়া, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, ঝড়-বৃষ্টি বা অন্য কোনো ওজর না থাকলে মসজিদের পরিবর্তে মাঠে বা ঈদগায় গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া। সম্ভব হলে এক রাস্তায় যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, ঈদুল ফিতরে ঈদগায় যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নেয়া এবং নিজ পরিবারের জন্য সাধ্যমতো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা। তবে ঈদুল ফিতরের দিনে ফজরের ফরজ নামাজের পরে ঈদের জামাত পর্যন্ত আর কোনো সুন্নত বা নফল নামাজ পড়া সমীচিন নয়।

ইসলাম শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ একটি ধর্মের নাম নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। বিজাতীয় কোনো কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতি ধার করা বা আমদানি করার কোনো সুযোগ রাখেনি ইসলাম। এর জলন্ত প্রমাণ ঈদ। হুজুর (সাঃ) হিজরত করে মদিনায় আসার পর দেখলেন, মদিনার লোকেরা বছরে দু দিন আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবে আমোদফূর্তি এবং খেলাধুলায় লিপ্ত হয়। এটি ছিলো ইসলামপূর্ব জাহিলিয়াত যুগের রীতি। হুজুর (সাঃ) সাহাবীদেরকে এটি করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন যে, আল্লাহ তায়ালা এই দু দিনের পরিবর্তে এর চেয়েও উত্তম দুটি দিন তোমাদিগকে দান করেছেন- ঈদুল আজহার দিন এবং ঈদুল ফিতরের দিন (মেশকাত: আবু দাউদ)। প্রত্যেক জাতিরই একটি খুশির দিন থাকে, আর মুসলিম জাতির খুশির দিন হলো দু ঈদ। ঈদ আমাদেরকে সাম্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শেখায়। এ কারণেই ঈদগায় যাওয়ার পূর্বেই ফিতরা আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছে ধনীদের, যাতে অভাবী, গরিব-দুখিরাও ঈদের আনন্দ মিছিলে শরিক হতে পারে। আমরা সাধারণত আনন্দ-ফূর্তির সময় মহান স্রষ্টার কথা বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু ঈদ হলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আনন্দ-ফূর্তির সাথে সাথে আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদতও এই দিন মানুষ বেশি করে থাকে। ঈদের দিনে সকল মুসলিম আল্লাহর প্রশংসা বার্তা ‘আল্লাহ আকবার আল্লাহ আকবর…………’ ধ্বনি দিতে দিতে ঈদগায় যায়। শুধু মাটির মানুষ নয়, এই আনন্দ ফোয়ারায় যোগ দেন স্বয়ং আসমানের নূরের ফেরেশেতারা। এমনকি মহান রাব্বুল আলামিনও এই দিন বান্দাদের প্রতি খুশি ও সন্তুষ্ট হয়ে পুরস্কার প্রদান করেন এবং সবাইকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন।

এক দীর্ঘ হাদিসে এ বিষয়টি এভাবেই ব্যক্ত করা হয়েছে, যখন ঈদুল ফিতরের রাত হয় তখন আসমানে তাকে পুরস্কারের রাত হিসাবে অভিহিত করা হয়। ঈদের দিন সকালে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদিগকে প্রত্যেক শহরে পাঠিয়ে দেন। তারা জমিনে অবতরণ করে প্রত্যেক অলিগলি ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যান এবং এমন আওয়াজে যা জিন ও মানব ব্যতীত সকল সৃষ্টিই শুনতে পায়- ডাকতে থাকেন যে, হে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মত! পরম দয়াময় পরওয়ারদিগারের দরবারে চল, যিনি অপরিসীম দাতা ও বড় থেকে বড় অপরাধ ক্ষমাকারী। অতঃপর যখন মানুষ ঈদগার উদ্দেশে বের হয় তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদিগকে জিজ্ঞাসা করেন, যে মজদুর তার কাজ পুরা করেছে তার বিনিময় কি হতে পারে? ফেরেশতারা আরজ করেন, হে আমাদের মা’বুদ, আমাদের মালিক! তার বিনিময় ইহাই যে তাকে পুরাপুরি পারিশ্রমিক দেয়া হোক। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, হে ফেরেশতারা! আমার বান্দা ও বান্দীগণ আমার দেয়া ফরজ হুকুমকে পরিপূর্ণভাবে পালন করেছে, এখন উচ্চস্বরে দোয়া করতে করতে ঈদগার দিকে রওনা হয়েছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহ এরশাদ করেন, ফেরেশতাগণ তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমি তাদের রোজা ও তারাবির বদলায় আমার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা দান করলাম। এরপর বান্দাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, হে আমার বান্দারা! আমার কাছে চাও। আমার মহান ইজ্জত ও বুযুর্গীর কসম, আজকের দিনে ঈদের এই জামাতে তোমরা যা কিছু চাইবে তাই দান করবো। আমার ইজ্জতের কসম, যতোক্ষণ তোমরা আমার প্রতি দৃষ্টি রাখবে ততোক্ষণ আমি তোমাদের অপরাধ গোপন করতে থাকবো। আমার ইজ্জত ও বুযুর্গীর কসম! আমি তোমাদিগকে অপরাধী কাফেরদের সম্মুখে লজ্জিত করবো না। তারপর বান্দাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, যাও আমি তোমাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিলাম এবং তোমাদের গুনাহগুলিকে নেকির দ্বারা বদলিয়ে দিলাম। তোমরা আমাকে রাজি করেছো, আমিও তোমাদের ওপর রাজি হয়ে গেলাম। ফেরেশতাগণ ঈদের দিনে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতের এ পুরস্কার ও সওয়াবকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন (মেশকাত, বায়হাকি শো’আবুল ইমান, তারগিব)। তাই আসুন আমরা মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি যাতে তিনি ঈদের অনাবিল আনন্দের সাথে সাথে তার ঘোষিত সমস্ত পুরস্কার ও কল্যাণের মধ্যে আমাদেরকে শামিল করেন। আমিন।