সব কিছু ঠিকঠাক রেখে যুগের সাথে তাল মেলাও -হোসেন জাকির

আধুনিকতার জোয়ারে ভাসছি আমরা। আমাদের জীবনোন্নয়নের অনেক কিছুই এনে দিয়েছে আধুনিকতা। আরো হয়তো পাবো। মানব জীবনে আমরা কতোটা পেয়েছি জানা নেই। সবাই সুখ সন্ধানে ব্যস্ত, কেউই পুরোপুরি সুখি নয়। ঘরে বসে মোবাইলফোনের মাধ্যমে জানতে পারছি কোন ট্রেন কোথায় অবস্থান করছে। এখন স্টেশন মাস্টারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সুখ এখন আমাদের হাতের নাগালে। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে সেই ডাকপিয়ন ও রানারের অপেক্ষা করতে হয় না। গোটা পৃথিবীই এখন হাতের মুঠোয়। এক সময় চিঠির জন্য ডাকপিয়নের অপেক্ষায় থাকতো মানুষ। অপেক্ষার ফল ছিলো মধুর। এখন ডিজিটাল যুগের চাওয়া পাওয়ার ছবি সবসময় সামনে। তাই ভালোবাসার ততোটা দাম নেই। বর্তমান সময়ের মতো এতো প্রতিযোগিতা আগে ছিলো না। তখন শিক্ষার মান, মানুষের বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, সম্প্রীতিসহ সবকিছুতেই একটা মাপকাঠি ছিলো। এখন কোনো ক্ষেত্রেই সেই প্রয়োজনের সঠিকতা নেই। সবকিছুতেই কেমন যেনো মূল্যবোধের মাপকাঠিটা হারিয়ে ফেলছি। এ যুগের ছেলে-মেয়েরা অধিক শিক্ষিত হয় অল্প সময়ের মধ্যে। সাথে সাথে বাবা-মাকেও ব্যস্ত থাকতে হয়। ছেলে-মেয়েদের দ্রুতগতিতে কীভাবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়। সবকিছুতেই সংক্ষেপে সম্পন্ন করার প্রবণতা এখন আমাদের মধ্যে। পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই রুটিন মাফিক। এমন কি ছেলে-মেয়েরা নিজ হাতে খাবার গ্রহণ করার সময় পায় না। ভাত-তরকারি একসাথে মেখে তৈরি করে রাখতে হয়। দ্রুত খাও, স্কুলের খাবারটাও দ্রুত খেতে হয়। যেমন দ্রুত খেয়ে স্কুলে, দ্রুত ঘুমাও এবং প্রাইভেটে যাওয়া। সবকিছুই যেন টি-টোয়েন্টি খেলার মতো। অল্প সময়ে বেশি রান। জীবনের সব কাজ একসাথে রোবর্টের মতো সম্পন্ন করতে পারলে আরো ভালো হতো। প্রতিযোগিতার কারণে শিক্ষার মান বাড়ছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দূরত্ব বাড়ছে ভ্রাতৃত্ববোধ, মায়া-মমতা, দেশপ্রেমে। এ যুগের ছেলে-মেয়েরা ‘মায়ের আঁচলের নিচে বড় হচ্ছে। মা-বাবাকে ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যখন বাইরে যাচ্ছে তখন ভেগাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে। কী করি কখন ঘুমায়। নতুন জীবনে প্রবেশের পর তারা কী করবে ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছে না। যখন বাইরের পরিবেশের সাথে স্বাধীনভাবে মিশতে শিখছে; আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে; তখন তাদের নানা রকম আবদার বা চাহিদা বাড়ছে। ব্যবহারিক জিনিসপত্রের মডেল পরিবর্তনের প্রবণতাও বাড়ছে। দৈনন্দিন চাহিদার যেমন শেষ নেই। মা-বাবার গণ্ডির বাইরে যাওয়ার পরে মা-বাবাও সন্তানের ভালো থাকার জন্য চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য অধিক অর্থের প্রয়োজন। যেখানে অর্থের প্রতিযোগিতা। এ অধিক অর্থ কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে লেখাপড়ার কাজে লাগাচ্ছে। আবার কেউ কেউ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করছে। তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ব, আত্মীয়তার বন্ধন, দেশপ্রেমের স্বল্পতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লেখাপড়া ছাড়া তারা যেন অন্য কিছুই আর বঝুতে চাইছে না। সবকিছুতেই কেমন যেনো চালাকি মনে হচ্ছে। দিন যতো যাচ্ছে বিবেকের ওপরে ছুরি চলছে। অতীতের দিকে তাকালে বোঝা যায় পূর্বের সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতা ও দেশের কাজে নিয়োজিত বড় বড় কর্মকর্তাদের নৈতিকতায় মুগ্ধ থাকতো সকলে। সেই সময় কিন্তু এতো আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়নি। তাদের দিকনির্দেশনা, আচার ব্যবহার, শাসনও ছিলো খুবই চমৎকার ও মধুর। খারাপ-ভালো সবসময় থাকবে। খারাপ ভালোর মাত্রাই বড় কথা। সাধারণ মানুষ খারাপকেই বেশি অপছন্দ করে। যুগের পরিবর্তন যতো ঘটছে দেখে শেখার প্রবণতা ততো বাড়ছে। আর এ দেখে শিখতে গিয়েই কী খায়, কী করি, কখন ঘুমায়- বুঝে ওঠা মুশকিল। সমাজ ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে। যোগ্যতানুযায়ী সমাজপতি, নেতা-নেত্রী, সংগঠন, উপযুক্ত বলেই মনের ভেতর বাড়ছে গ্রুপিঙের চিন্তা। নিজেদের ভেতরে গ্রুপিং হবে কেন? নেতা এক, প্রতীক এক, গ্রুপিঙের কথা চিন্তা করাও যায় না। সাধারণ জনগণ নিঃস্বার্থে দলকে ভালোবাসে গ্রুপিঙের বিশৃঙ্খলার কথা তারা কোনো সময় চিন্তাও করে না। তারা দলের শান্তি কামনা করে। প্রবীণ নেতাদের কোনো তুলনা হয় না। সে যে দলের নেতা হোক না কেন? প্রবীণ নেতারা দলের কথা চিন্তা করে এবং ভবিষ্যতেও করবে আশা করা যায়। অনেক ধৈর্য ধারণ করে দলের জন্য কয়েক বছর পরিশ্রম করে একটি পদ পাওয়া ও দেয়া হতো। বর্তমানে পদ পাওয়া আর যাওয়া কখন কোনো সময় হয় তা বোঝা মুশকিল। এটা কিন্তু শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, সংগঠন প্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রেই এ ধরনের চলছে। যোগ্য ব্যক্তিকে নেতৃত্ব দেন। নিজ স্বার্থের জন্য রাজার যে নীতি অযোগ্য ব্যক্তির হাতে তুলে দিলে সমাজ ব্যবস্থা দিন দিন লাগামহীন ঘোড়ার মতো চলতে থাকবে। আজ যেসব অযোগ্য ব্যক্তির হাতে সমাজ ব্যবস্থার লাগাম, ৫/১০ বছর পরে এসব অযোগ্য ব্যক্তিরা সিনিয়র নেতাতে পরিণত হবেন। তখন তাদেরকে উচ্চ পদ থেকে আর অপসারণ করা সম্ভব হবে না। এজন্য দলের যোগ্য পুরোনো নেতাদেরকে বিভিন্ন ধরনের মুশকিলে পড়তে হবে। প্রতিটি দলের ও প্রতিষ্ঠানের নেতানেত্রীদের চেন অব কমান্ড থাকা উচিত। চেন অব কমান্ড হারিয়ে যাওয়ার কারণে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মূল্যহীন হয়ে পড়েছেন। দলে অতিথি পাখি হিসেবে যারা ঢোকেন তাদের মূল্যায়ন বেশি হতে দেখা যায়। অনেকেই দাবি করেন বিভিন্ন দলে দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া নেতাদের মূল্যায়ন কম হয়। এভাবে চলতে থাকলে ভদ্র সুশীল সমাজের শান্তি তো যাবেই এর সাথে পুরোনো যোগ্য নেতা যারা দলকে ভালোবাসে তাদেরকেও অসম্মানিত হতে হবে। আধুনিকতার উন্নয়ন হবে এমনটা আমরা সকলেই চাই।