সাংবাদিক খুন : উন্মোচন হোক খুনের প্রকৃত কারণ

 

আমরা মর্মাহত, আমরা স্তব্ধ। সকল সাংবাদিক আজ শোকাহত। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে একজন কলমসৈনিককে তার বাড়ির দোতলায় উঠে বুকে চাকু মেরে খুন করেছে এক দুর্বৃত্ত। গত পরশু রাত ১১টার দিকে চাকু মারে। তাকে ঢাকায় নেয়া হয়। গতকাল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পুলিশ গতকাল খুনিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। ধরা পড়া ব্যক্তিই যে- সেই ব্যক্তি তাও শনাক্ত করেছেন সাংবাদিক আবু সায়েমের পিতাসহ পরিবারের সদস্যরা। এরপরও পুলিশের কিছু বক্তব্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পিত খুনের বহু আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠলেও নেশাখোরের অপকর্ম বলে ঢালাও মন্তব্য হতাশার কারণ। এতে ঘটনার আড়ালে থাকা চক্রান্তকারীরা পার পেয়ে যেতে পারে নাকি?

খুনি কয়েকদিন ধরে সাংবাদিক আবু সায়েমের বাড়ির আশেপাশে ঘুর ঘুর করেছে। কয়েকদিন আগে ছদ্মবেশে ভিক্ষুক সেজে বাড়ি ঢুকে ভাত খেয়েছে। ঘটনার রাতে বাড়ির দোতলায় উঠে সাংবাদিক আবু সায়েমের জন্যই অপেক্ষা করেছে। বালিশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে চাকু। শয়নকক্ষ থেকে ডাইনিং স্পেসে বের হতেই সাংবাদিকের বুকে ছুরিকাঘাত করেছে। বুকে ছুরিকাঘাতের ধরন দেখে যে কেউই বলবেন, খুনের জন্যই বুকে ছুরিকাঘাত। কয়েকদিন ধরে বাড়ির আশেপাশে ঘোরা, ছদ্মবেশে বাড়ি ঢুকে ভাত খাওয়ার অছিলায় বাড়ি ঘরের বিস্তারিত জানা, দোতলায় ওঠা এবং পালানোর পথটিও ঠিক করে রাখা কি পূর্ব পরিকল্পিতের অংশ নয়? পরিকল্পিত খুনের আড়ালে অনেক কিছুই লুকিয়ে থাকে। থাকে অনেকের চক্রান্তও। যে ব্যক্তি খুন করেছে তার সাথে সাংবাদিক আবু সায়েমের পূর্ব বিরোধ নেই। তা হলে কি তাকে খুন করতে কেউ প্ররোচনা করেছে? একজন সাংবাদিককে খুন করার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন দানা বাধে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার মধ্যে এ প্রশ্ন যদি গুরুত্বহীন হয় তা হলে খুনের আড়ালে কেউ ষড়যন্ত্র করে থাকলেও সহজেই কি পার পেয়ে যাবে না?

চুয়াডাঙ্গা জীবননগর উপজেলার পিয়ারাতলা গ্রামের আবুল খায়ের বাচ্চু মোল্লার ছেলে আবু সায়েম শুধু সাংবাদিকতাই করতেন না, তিনি ব্যবসায়ীও ছিলেন। প্রবাসে পরিশ্রম করে অর্থও এনেছেন তিনি। সাংবাদিকতার কারণে খুনের ঘটনা, নাকি ব্যবসার কারণে কারো সাথে বিরোধ? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অথচ ঘটনার পর থেকেই জীবননগর থানার অফিসার ইনচার্জসহ সংশ্লিষ্টরা এ ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে মানতে নারাজ। গ্রেফতারকৃত খুনি নেশাখোর, নেশাগ্রস্ততার কারণে অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলছে বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা। এ ধারণার ওপর ভর করে তদন্ত চললে তার ফলাফল কী হবে? অবশ্যই নিরপরাধ একজনও যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তাই বলে ঘটনাকে নেশাখোরের খামখেয়ালি বা চুরি করতে ঢুকে ঘটনাক্রমে খুন করে ফেলেছে বলে চালানো মানে একজন সাংবাদিকে খুনের বিষয়টিকে খুবই হালকাভাবে দেখা নয় কি? নেশাখোর চোর কখনো কয়েকদিন ধরে একই এলাকায় ঘুর ঘুর করে না। একটি বাড়িতে ওভাবে প্রবেশ এবং পালানোর পথ ঠিক করে রাখে না। নেশাখোর ছিঁচকে চোরের হাতে অতো বড় ধারালো অস্ত্র কেন? কেনইবা লাল শালু? নেশাখোরকে কাজে লাগিয়ে চতুর কেউ কি স্বার্থ সিদ্ধি করেছে? এ প্রশ্নের জবাব জানতে পুলিশের দক্ষ দৃষ্টি দিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি নিশ্চয় অমূলক নয়।

সাংবাদিক আবু সায়েম ছিলেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সমকাল পত্রিকার জীবননগর উপজেলা প্রতিনিধি। তিনি সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অন্যের গোপন তথ্য পেয়ে যেতে পারেন। গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার শঙ্কায় কেউ খুনি ভাড়া করতে পারেন। তিনি ব্যবসায়ীও ছিলেন। ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা কোনো চক্রের কাছে লগ্নিও করতে পারেন। খুনের আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ অমূলক নয়। অবশ্যই সায়েম খুনের প্রকৃত কারণ উন্মোচন করতে হবে। সরাসরি খুনে অংশ নেয়া ব্যক্তিকে দ্রুত গ্রেফতার করতে সক্ষম হওয়ায় অবশ্যই জীবননগর থানা পুলিশ সাধুবাদ পাবার দাবি রাখে। যেহেতু খুনি ধরা পড়েছে সেহেতু খুনের প্রকৃত কারণ উন্মোচন হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।