ঝিনাইদহে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দ লোপাটের অভিযোগ!

 

পাকা সড়কে মাটি ভরাট, নির্মিত মসজিদের নামে নির্মাণ বরাদ্দ : টাকা নিলেও সরেনি কচুরিপানা

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহে সরকারের টেস্ট রিলিফ-টিআর ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কাবিখা প্রকল্প নিয়ে হরিলুট চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার কয়েকটি প্রকল্প পরিদর্শন করে দেখা গেছে, পিচ ঢালা রাস্তা থাকলেও সেখানে রাস্তায় মাটি ভরাটের নামে ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে বরাদ্দকৃত চাল লুটপাট করা হয়েছে। কাগজে-কলমে ব্যায়ামাগার নির্মাণের কথা বলা হলেও এর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। দু বছর আগে মসজিদ নির্মাণ করা হলেও সেই মসজিদ নির্মাণের নামে লোপাট করা হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। আর কচুরিপনা অপসারণ করার জন্য প্রায় দেড় লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও নদী থেকে একটি কচুরিপনাও তোলা হয়নি। গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের নামে এভাবেই সংসদ সদস্যদের বরাদ্দ দেয়া চাল-অর্থ লুটপাট চলছে এ ছোট্ট উপজেলায়। যদিও ঘাটে ঘাটে বখরা দিয়েই এসব করা হচ্ছে। ফলে যাদের দেখার কথা তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন।

সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন ঘুরে টিআর ও কাবিখা কর্মসূচির এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শহরের ধোপাঘাটা ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম দিকের সংযোগ সড়কটি অনেক আগেই পাকা করেছে ঝিনাইদহ পৌরসভা। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ সড়কটিতে মাটি ভরাটের জন্য ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। অথচ বছর দুয়েকের মধ্যে এ সড়ক এলাকায় এক ঝুঁড়ি মাটিও ফেলতে দেখা যায়নি।

আবার ধোপাঘাটা ব্রিজের নিচে একটি ব্যায়ামাগার নির্মাণের জন্য ৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। অথচ ব্রিজের নিচে কয়েকদিন আগেও বেদেরা ঝুঁপড়ি  তৈরি করে বসবাস করেছে। আশপাশের লোকজন জানালেন, এখানে কোনো ব্যায়ামাগার নেই। কেউ কখনও নির্মাণের উদ্যোগও নেয়নি। অথচ আগের অর্থবছরেই শেষ হয়ে গেছে এসব রিলিফের কাজ। অবশ্য তত্কালীন সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম অপু এ প্রতিবেদককে বললেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি। ৫ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত ঝিনাইদহ সদরের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। নির্বাচনে তাকে পরাজিত করে নতুন এমপি হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকী।

অপু বলেন, ব্যায়ামাগারের জন্য যন্ত্রপাতি কিনে আমি বাসায় রেখেছি। সুবিধামতো সময়ে সেটি স্থাপন করা হবে। আর ভুয়া সড়ক প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্পটি আসলে ভুল দেখানো হয়েছে। আসলে ওটা ছিলো প্রধান সড়ক থেকে ব্যায়ামাগারে যাওয়ার রাস্তা। তাহলে সেই রাস্তাটিই বা কই? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্যায়ামাগার নির্মাণের পরই ওই সড়কটি নির্মাণ করা হবে।’ প্রকল্পের সময় শেষ, টাকাও তোলা হয়েছে- কিন্তু কাজ তো হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তখন কিছু সমস্যা ছিলো।

জানা গেছে, গত বছরের ৫ জানুয়ারির আগে প্রত্যেক এমপিকে ৩শ টন করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। তত্কালীন সংসদ সদস্য অপু এ ৩শ টনের মধ্যে সদর উপজেলায় ৬৮টি প্রকল্পে ১৮০ টন ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ১২০ টন চাল দেন। এর মধ্যে ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় কবরস্থানের জন্য ৪ প্রকল্পে ২০ টন, হাসপাতাল ও সুইপার কলোনিতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ৪৮ টন, ধোপাঘাটা খেলার মাঠের উন্নয়নের জন্য ৬ টনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কোন কাজই হয়নি বলে স্বীকার করেন শফিকুল ইসলাম অপু। তবে এ কাজটি তিনি এখনো করার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করলেন।

এসব কাজ হয়েছে সদর উপজেলার মধ্যেই। উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল আলিমের কাছে প্রশ্ন ছিল কাজগুলো কেমন হয়েছে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানকে এসব বিষয়ে কিছুই অবহিত করা হয় না। ফলে তার পক্ষে কোথায় কোন প্রকল্প যাচ্ছে তা জানার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি কাজ হচ্ছে কি-না তা দেখারও সুযোগ নেই।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মহসীন আলী বলেন, সাবেক এমপি সফিকুল ইসলাম অপু তার ক্ষমতার জোরে সব প্রকল্পের কাজ তার পিএস রবিউল ইসলামকে দিয়ে করিয়েছেন। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের এমপির কোনো প্রকল্প দেখভাল করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই এমপির বরাদ্দকৃত কাজের দায়িত্ব তার নিজের।

এদিকে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৪-১৫) ঝিনাইদহ সদরের বর্তমান স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী টিআর কর্মসূচির আওতায় উপজেলার জন্য একটি আদেশে গত ১২ মে ১২৮টি প্রকল্পের জন্য ৪৪ লাখ টাকা নগদ বরাদ্দ দেন। ওই ১২৮টি প্রকল্পের মধ্যে শুধুমাত্র একটি এলাকায়ই ১৬টি প্রকল্পে প্রায় ২০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এ তালিকার ৪৪ নম্বরে থাকা প্রকল্পে ধোপাঘাটা গোবিন্দপুর থেকে ভুটিয়ারগাতী পর্যন্ত নবগঙ্গা নদীর কচুরিপনা অপসারণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অথচ সরেজমিন দেখা গেছে নদীটি কচুরিপনা মুক্ত হয়নি।  আবার ভুটিয়ারগাতী মুন্সিপাড়া জামে মসজিদ নির্মাণের জন্য দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সরেজমিনে ওই মসজিদে গেলে কমিটির কোষাধ্যক্ষ বাচ্চু মুন্সী এ প্রতিবেদককে বলেন, বছর দুইয়েক আগে মসজিদটি এলাকার মানুষের টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে। সংসদ সদস্যের টিআরের কোনো অর্থ তারা পাননি। এছাড়া মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরাও জানান, কোনো অনুদানের অর্থ এই মসজিদে পৌঁছেনি।

মুন্সিপাড়া জামে মসজিদটির ঠিক পাশেই ভুটিয়ারগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মাটি ভরাটের জন্য দেয়া হয়েছে আরো ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সেখানে অবশ্য কিছু মাটি পড়েছে। কিন্তু বরাদ্দ আর কাজের সাথে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এমপি তাহজীব আলম সিদ্দিকী বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় এসব ব্যাপারে তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রত্যেকটি প্রকল্প দেখেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কেউ যদি কোনো টাকা না পেয়ে থাকে অবশ্যই তিনি টাকা পাবেন। এমপি সাহেব কাউকে লুটপাট করে খাওয়ার সুযোগ দেবেন না। জবাবদিহিতাই তার কাছে বড় কথা।’

ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঝিনাইদহ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপির। এমপি স্বতন্ত্র। তাই এখানে আওয়ামী লীগের লোকজন পরবাসী। ফলে বর্তমান কোনো কাজের সাথে আওয়ামী লীগের লোকজনের সম্পৃক্ততা নেই। এমপি তার বরাদ্দ দিচ্ছেন তার পছন্দের লোকদের। সেগুলো তারা লুটেপুটে খাচ্ছে। আমরা সেসবের কিছুই জানি না।’ কাজ কেমন হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবই তো লুটপাট হচ্ছে, কোথাও কাজ হচ্ছে এমন কথা তো শুনছি না। আমাদের কাছে লোকজন শুধু লুটপাটের খবরই দিচ্ছে।’

Leave a comment