লতিফ সিদ্দিকীর এমপি পদ নিয়ে লুকোচুরি

স্টাফ রিপোর্টার: টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতি) থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর জাতীয় সংসদের সদস্য পদ নিয়ে লুকোচুরি হচ্ছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় ৯ মাস আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। এমনকি দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও তাকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ বহিষ্কারের বিষয়টি এখনো লিখিতভাবে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে অবহিত করেনি।

স্পিকারও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লতিফ সিদ্দিকীর বহিষ্কারের বিষয়টি তিনি অবগত নন। ফলে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পরও তার সংসদের আসন বহাল রয়েছে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত শনিবার দাবি করেছেন, লতিফ সিদ্দিকী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসাবে জনপ্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। তিনি বলেছেন, সংসদ সদস্য পদ যায় দু কারণে। একটি হলো দলের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দিলে। আরেকটি ওই সংসদ সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করলে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী কোনোটিই করেননি। তাই বুঝতে হবে, তার সদস্য পদ আছে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন না করেও কেবল দল থেকে বহিষ্কৃত হলে জাতীয় সংসদের সদস্য পদ থাকে না-এমন নজির আমাদের রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনের এ সংক্রান্ত সর্বশেষ দু’টি রায় ও নির্দেশনা অনুযায়ী দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনের এ মন্তব্যের পর লতিফ সিদ্দিকীর সদস্য পদ নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বহিষ্কৃত হওয়ার পরেও স্পিকারকে অবহিত না করার বিষয়টি তথ্য গোপনের অপরাধে দুষ্ট।

লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কারের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তার প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল হওয়ায়-এ সংক্রান্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হবে। গত ১২ অক্টোবর এ ঘোষণা দেয়ার পর বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে প্রেরণের জন্য আওয়ামী লীগ স্পিকারের কাছে এখনও কোন চিঠি দেয়নি। আইনবিশেষজ্ঞরা এটাকে কূটকৌশল বলে অবহিত করেছেন। অন্যদিকে, বিষয়টি উচ্চ আদালতের সর্বশেষ নির্দেশনাকে পাশ কাটানোর একটা চেষ্টা। আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে ফ্লোর ক্রসিং হিসেবে অবহিত করা হয়। এতে বলা হয়েছে ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ-সংসদ্য হইবার অযোগ্য হইবেন।’

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মূলত ৭০ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়েই লতিফ সিদ্দিকীর আসন বহাল রয়েছে বলে দাবি করেছেন। ঠিক একইরকম দাবি উঠেছিল সপ্তম জাতীয় সংসদে। সুরঞ্জিত সেনসহ তত্কালীন সংসদের সরকারি দলের সদস্যরা একই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সে সময় বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রাজশাহী-৫ আসনের ডা. আলাউদ্দিন এবং সিরাজগঞ্জ-৭ আসনের হাসিবুর রহমান স্বপন আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপি তখন তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করে স্পিকারকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করে। কিন্তু তত্কালীন স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে না পাঠিয়ে সংসদে একটি রুলিং দেন। তাতে স্পিকার উল্লেখ করেন, তারা বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেননি। বিএনপি সংসদীয় দলের হুইপিং লঙ্ঘন করে কোনো বিলে ভোটদান করেননি। এ কারণে স্পিকার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান। পরে বিষয়টি হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। আলাউদ্দিন ও স্বপন বনাম রাষ্ট্র মামলায় ১৯৯৯ সালের ২৯ জুলাই আপিল বিভাগ রায় ও নির্দেশনা দিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করেন। এটি একটি নিষ্পত্তিযোগ্য বিষয়।

আপিল বিভাগ অভিমত দেয়, দল থেকে বহিষ্কার একটি নীতি এবং আদর্শের পরিবর্তন। আলাউদ্দিন এবং স্বপন নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর সংসদে তারা আর ওই দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না। আপিল বিভাগ এটিকে নির্বাচনী বিরোধ হিসাবে আখ্যাদেন। একইসাথে সর্বোচ্চ আদালত তার রায়ে বলেন, এটি স্পিকারের রুলিং দেয়ার বিষয় নয়। স্পিকারের কাছে বিষয়টি উত্থাপিত হওয়া মাত্র সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী এটি নির্বাচন কমিশনে পাঠাতে হবে। আলাউদ্দিন ও স্বপনের বিষয়ে সিদ্বান্ত ঘোষণার জন্য স্পিকারকে বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর স্পিকার কাল বিলম্ব না করে বিরোধটি নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেন। পরে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ১৯৯৯ সালের ১১ অক্টোবর এ দু সংসদ সদস্যের সংসদের আসন শূন্য ঘোষণা করে বিষয়টি স্পিকারকে অবহিত করেন। তত্কালীন স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী এ দু সংসদ সদস্যের আসন শূন্য ঘোষণা করেন। ফলে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েও সংসদ সদস্য পদ খারিজ হওয়ার নজির আমাদের রয়েছে।

আইনবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দল থেকে নির্বাচিত কোনো সদস্য কখনোই স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না। কেননা নির্বাচক মণ্ডলীরা দলীয় প্রার্থী এবং ওই দলের আদর্শ পছন্দ করেই তাকে নির্বাচিত করেছেন। স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নয়। লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে দল থেকে বহিস্কারের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচনে তার দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাহার হয়ে গেছে। আবার স্বতন্ত্র হিসাবেও তিনি নির্বাচিত হননি। বহিষ্কার হওয়ার পর কারোর সদস্য পদ থাকে না -এটি একটি মীমাংসিত ইস্যু।