পশুখাদ্য হিসেবে প্রস্তুত করছে চুয়াডাঙ্গার ফ্লাওয়ার মিলগুলো

ব্রাজিল থেকে সরকার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা গম
স্টাফ রিপোর্টার: ব্রাজিল থেকে আমদানি করা লাখ লাখ টাকার গম এখন পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গায় এ গম পশু-পাখির খাবারের জন্য ভূষি হিসেবে প্রস্তুত করছে ফ্লাওয়ার মিলগুলো।
জানা গেছে, এসব মিলমালিক এক রকম বাধ্য হয়েই নষ্ট ও পোকায় খাওয়া গম কিনছেন। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিস বলছে, গমের মান ভালো। নানা অভিযোগের পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে গমের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ব্রাজিল থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ গম আমদানি করে। ৩টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ গম আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ২ লাখ মেট্রিক টন গম মংলা বন্দরে জাহাজ থেকে খালাস করে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় পাঠানো হয়েছে। যার মধ্য থেকে প্রায় ৯শ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ পেয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলা। সরবরাহ করা গমের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদরের লোকাল সাপ্লাই ডিপোতে আছে ৫শ, সরোজগঞ্জ ডিপোতে ১শ, আলমডাঙ্গায় ১শ এবং দামুড়হুদার দর্শনায় রয়েছে ১৮৩ মেট্রিক টন। ১৬ জুন এসব গম চুয়াডাঙ্গার সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে এসে পৌঁছে। এরই মধ্যে গম বিলি-বিতরণ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছেন, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা এ গম মানুষের জন্য খাদ্যোপযোগী নয়। লালচে রঙের ছোট ছোট দানার এসব গমের মধ্যে গিজগিজ করছে পোকা। বেশির ভাগ গমই পোকায় খেয়ে খোলসা করে ফেলেছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা খাদ্য বিভাগের তালিকাভুক্ত ফ্লাওয়ার মিলগুলো এসব গম নিয়ে বিপাকে পড়েছে। বাধ্য হয়ে তারা গম নিয়ে পশু-পাখির খাদ্য হিসেবে বিক্রি করছেন।
চুয়াডাঙ্গার জাহিদ ফ্লাওয়ার মিলসের স্বত্বাধিকারী জাহিদ মিয়া ও হাসান ফ্লাওয়ার মিলসের স্বত্বাধিকারী জামিউল হাসান জোয়ার্দার জানান, এমন নিম্নমানের গম আগে দেখিনি। এ গম মোটেও মানুষের খাবার উপযোগী নয়। এতে আটা নেই। এ গম আমরা নিচ্ছি না। খাদ্য বিভাগের চাপাচাপিতে কিছু গম নিয়ে ভাঙিয়ে তা ভূষি করে পশু-পাখির খাদ্য হিসেবে বিক্রি করছি। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আবদুল ওয়াহেদ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, গমের মান ভালো। মিলাররাও স্বেচ্ছায় নিচ্ছেন। টিআর, কাবিখা প্রকল্পেও গম বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। গমের মান নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
এদিকে শুভঙ্করের ফাঁকি ছিলো দরপত্রের প্রক্রিয়াতেই। আর সে সুযোগ ষোল আনা কাজে লাগানো হয়েছে পচা গম আমদানিতে। দরপত্রে অতিমাত্রায় কম মূল্য দেয়ার বিষয়টি আদৌ যাচাই করা হয়নি। শর্তজুড়ে দেয়া হয়নি বিপুল পরিমাণ গম সম্ভাব্য কোন কোন দেশ থেকে আনতে হবে। দরপত্র প্রক্রিয়া ও পিপিআরের (সরকারের ক্রয় নীতিমালা) এ জাতীয় ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে ৪শ কোটি টাকার ২ লাখ টন নিম্নমানের গম সরবরাহ করেছে ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল ও ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামের দু বিদেশি প্রতিষ্ঠান। নিম্নমানের এ গমকেই ‘ভালো’ হিসেবে সনদ দিয়েছে খাদ্য অধিদফতরের নির্দিষ্ট পরীক্ষাগার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদেশ থেকে গম আমদানির দরপত্র আহ্বানের সময় ব্রাজিলে ভালো মানের প্রতি টন গমের রফতানি মূল্য ছিল ২৮৭ মার্কিন ডলার বা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে কিছুটা বেশি। কিন্তু যে গম দেশে আনা হয়েছে সেটির মূল্য সর্বনিম্ন ২৪০ ডলার থেকে শুরু করে আড়াইশ ডলারের কাছাকাছি। এত কম দামে ব্রাজিলের বাজারে ভালো মানের গম পাওয়াই যায় না। অথচ ওই দেশ থেকেই কম দামে অতি নিম্নমানের গম কিনে তা সরকারকে গছিয়ে দিয়েছে কোম্পানি দুটি। দরপত্রে উল্লিখিত দামে মানসম্পন্ন গম আমদানি করা যাবে কিনা এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরকম মনিটরিং করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম মাথাভাঙ্গাকে বলেন, ব্রাজিলের গমের বিষয়টি এখন বিচারাধীন। আগামী রোববার এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে শুনানি হবে। কাজেই বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আমি কোনো কথা বলবো না।
জানা গেছে, গম আমদানির বছরে অর্থাৎ ২০১৪ সালে ব্রাজিলে গমের বাম্পার ফলন হয়েছে। দেশটির সরকারি হিসাবে ৭৫ লাখ মেট্রিক টন গম উৎপাদন হয়। বাম্পার ফলনের কারণে সেখানে গমের দাম কমে যায়। এ পরিস্থিতিতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সেখান থেকেই গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। তবে কম মূল্যে ভালো গম না এনে, বেশি মুনাফা করতে নিম্নমানের গম কিনে সরবরাহ করেছে।
দেশের অন্যান্য সংস্থা এ ধরনের কেনাকাটার সময় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য নষ্ট হলে ফেরত নেয়ার গ্যারান্টি নিয়ে চুক্তি করে। কিন্তু উল্লিখিত দরপত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত দেয়া হয়নি। এছাড়া খোঁজ নিয়ে সম্ভাব্য ভালো মানের গম উৎপাদনকারী একাধিক দেশের নামও উল্লেখ করা যেতো। দরপত্রের এসব দুর্বলতাই পচা গম আমদানির পথ সুগম করে দেয়, যা এখন কেলেঙ্কারিতে রূপ নিয়েছে। তবে গম নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও এখনও জবাবদিহিতার বাইরে রয়ে গেছে পচা গমের সরবরাহকারী দুপ্রতিষ্ঠান। খাদ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর থেকে প্রতিষ্ঠান দুটির কাছে এ বিষয়ে কোনোরকম জবাব চাওয়া হয়নি। ফলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দুটিকেও পচা গমের ব্যাপারে কাউকে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা দিতে হয়নি। গম নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চললেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইমপেক্স কনসালটেন্টস (বিডি) ও ওলাম ইন্টারন্যাশনাল।

Leave a comment