স্টাফ রিপোর্টর: আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখার দু শীর্ষ নেতাসহ ১২ জনকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও সরঞ্জামসহ আটক করা হয়েছে, যারা ঈদের পর রাজধানীতে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিলো বলে র্যাবের দাবি। র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, আটকদের মধ্যে মাওলানা মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে নানা ওরফে বদিউল (৩৫) একিউআইএস’র বাংলাদেশ শাখার প্রধান সমন্বয়ক। একসময় তিনি হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) সাথেও জড়িত ছিলেন। আর আটক মুফতি জাফর আমিন ওরফে সালমান (৩৪) একিউআইএসের একজন উপদেষ্টা।
লেখক অভিজিৎ রায় ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস খুন হওয়ার পর ওই জঙ্গি সংগঠনের পক্ষ থেকেই দায়িত্ব স্বীকার করে বার্তা দেয়া হয়েছিলো। বরাবরের মতোই এ জঙ্গি সদস্যদের আটকের কথা প্রথমে গণমাধ্যমকে জানানো হয় র্যাবের গণমাধ্যম শাখা থেকে এসএমএস পাঠিয়ে। পরে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে উত্তরায় বাহিনীর সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বিভিন্ন তথ্য জানান।
তিনি বলেন, র্যাব-৪ এর একটি দল গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত বুধবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সদরঘাটে অভিযান চালিয়ে প্রথমে মাওলানা মঈনুল, মুফতি জাফর, একিউআইএস বাংলাদেশ শাখার সদস্য মো. সাইদুল ইসলাম ওরফে সাইদ তামিম (২০), মো. মোশাররফ হোসেন (১৯) ও আব্দুর রহমান বেপারীকে (২৫) আটক করে।
পরে তাদের দেয়া তথ্যে গত বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় খুলনা থেকে আসা একিউআইএস বাংলাদেশের সদস্য আলামিন ওরফে ইব্রাহিম (২৮), মো. মুজাহিদুল আসলাম ওরফে নকীব ওরফে শরীফ (৩১), আশরাফুল ইসলাম রওফে আবুল হাশেম (২০), রবিউল ইসলাম ওরফে হাসান (২৮) ও মো. জাবিবুল্লাহকে (২৬) আটক করা হয়। এরপর মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের বর্ধনবাড়ি থেকে মো. শহীদুল ইসলাম ওরফে সাগর (২৯) ও আলতাফ হোসেন ওরফে আল মামুনকে (২৬) আটক করে র্যাব। ওই বাড়িতে পাওয়া যায় আড়াই লিটার সালফিউরিক অ্যাসিড, এক কেজি সালফার, ৪০০ গ্রাম পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৫৫০টি মার্বেল, উগ্র মতবাদসংবলিত বিভিন্ন ধরনের বই, ১৬টি মোবাইলফোন, চারটি নান চাকু, পাঁচটি ছুরি, একটি চাপাতি, দুটি চায়নিজ কুড়ুল, এক কার্টন দিয়াশলাই, ১৫টি বিস্ফোরক ডিভাইস এবং ১০টি ছোট ছুরিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ঈদের পর রাজধানীতে নাশকতা সৃষ্টির জন্য এরা ঢাকায় জড়ো হচ্ছিলো। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা মিরপুরে একটি বাসাও ভাড়া করেছিলো। তাদের বেশিরভাগই আসছিলো বরিশাল ও খুলনা থেকে।
র্যাব বলছে, আটক এই জঙ্গি সদস্যরা এক সময় নিষিদ্ধ সংগঠন হুজিতে সক্রিয় ছিলেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হুজির শীর্ষ নেতা মওলানা মুফতি মঈনুদ্দীন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ কাশিমপুর কারাগার থেকে মোবাইলফোন ও চিঠির মাধ্যমে আত্মগোপনে থাকা এ নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন।
তার নির্দেশনা অনুযায়ী এই জঙ্গি সদস্যরা প্রথমে দাওয়াতে তাবলিগ এবং পরে ৩১৩ বদরের সৈনিক নামে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। মুফতি মাহমুদ বলেন, আটকরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, আল-কায়েদার বিস্তার সামনে রেখে বাংলাদেশে সর্বাত্মক কার্যক্রম শুরু হলে তারা একিউআইএসে যোগ দেবে- এটাই ছিলো তাদের মূল লক্ষ্য। তারা আল-কায়েদা প্রধানের ভিডিওবার্তা ও আইএস জঙ্গিদের কার্যক্রম দেখে আরও তৎপর হয়ে ওঠার চেষ্টায় ছিলেন বলেও র্যাবের মুখপাত্রের দাবি।
তিন ধাপে কর্মী সংগ্রহ: সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অনেকটা চাপে থাকায় নতুনভাবে কর্মী সংগ্রহ শুরু করেছিলো আটক জঙ্গিরা। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনায় ছিলো তারা। মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দাওয়াতি তাবলিগে মূলত তিন ধাপে কর্মী সংগ্রহ হতো। ফেসবুকে উগ্রপন্থি ওয়েবসাইটে লাইক দিলে তাদের বলা হতো দ্বীন কায়েমের সাথী। দ্বিতীয় ধাপ হলো- বায়াতে ফি ছাবিলিল্লাহ। যারা আল্লাহর পথে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তারাই ওই নামে পরিচিত হতো। আর ওই সংগঠনের তৃতীয় ধাপ হলো শহীদি কাফেলা। যাদের ঈমান শক্ত এবং জিহাদে শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত, তারাই শহীদি কাফেলার আন্তর্ভুক্ত বলে আটকরা র্যাবকে জানিয়েছেন। আটকরা ৩১৩ বদরের সৈনিক নামে যে সংগঠন করার কথা ভেবেছিলেন, তার ২০ জনের একটি দল বগুড়ায় ২০ দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
সেই প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ট্রেনিং ম্যানুয়ালও উদ্ধার করা হয়েছে বলে র্যাবের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়। মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ৩১৩ বদরের সৈনিকের অর্থ যোগানদাতা রফিক নামের এক ব্যক্তি, যিনি সৌদি আরব ও দুবাই থেকে ফিদাই মওলা নামে ফেসবুক ব্যবহার করেন। আটকরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ড্রেনের রড কেটে হুজি নেতা মাওলানা মাঈন উদ্দিনকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু পরে তারা ওই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার পরিকল্পনা করে। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান, উপপরিচালক রুম্মান মাহমুদ ও সহকারী পরিচালক মাকসুদুল আলমসহ বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।