জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, ব্যাংক জালিয়াতদের ধরতে বাধা তার নিজের দলীয় লোকেরাই। বহুল আলোচিত হলমার্ক কেলেংকারি প্রসঙ্গে তিনি এই সত্য উচ্চারণে বাধ্য হয়েছেন শেষ পর্যন্ত। দেরিতে হলেও নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে দেয়া অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য দেশের অর্থ ব্যবস্থার সার্বিক নাজুক চিত্রই তুলে ধরে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকা জনগণের আমানত। সেই আমানতের খেয়ানতের অর্থ জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। এমন বিশ্বাসঘাতকতার সাথে যারা জড়িত তারা কোনোভাবেই জনগণের প্রতিনিধি হতে পারে না। বরং তারা জনগণের শত্রু। অথচ তারা সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে আত্মরক্ষা করছে। আবার এ দুর্বৃত্তদের ধরাও যাচ্ছে না, দেয়া যাচ্ছে না শাস্তিও। এর অর্থ দুর্বৃত্ত ও দুর্বৃত্তায়ন হয়ে উঠেছে শক্তিশালী। কতিপয় রাঘববোয়াল নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। তারা অবৈধ পন্থায় মানব পাচার করে বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলছে। অবৈধ মাদকে সারা দেশ ভাসিয়ে উপার্জন করছে অর্থ। তাদের ধরাও যাচ্ছে না, ছোঁয়াও যাচ্ছে না। এমনকি বলাও যাচ্ছে না তাদের নাম। উল্টো তারাই মানব পাচারের শিকার মানুষদের শাসিয়ে যাচ্ছে- মুখ খুললে বিপদ ঘটবে।
সত্য বড় কঠিন! হলমার্কের ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমগুলো যখন প্রতিবেদন করছিলো তখন এমনকি অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছিলেন, সামান্য টাকা নিয়ে প্রেস হইচই করছে। লাখো কোটি টাকার বাজেট প্রণেতা অর্থমন্ত্রীর কাছে সে টাকা সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু হাজার টাকা বেতনের মানুষের কাছে হাজার কোটি টাকা সামান্য নয় অবশ্যই। যে অর্থের সাথে নীতি সম্পর্কিত, সেই অর্থনীতির কাছে এক পয়সার হিসাবও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে অর্থের সাথে নীতির কোনো সম্পর্ক নেই, সেই অর্থনীতির কাছে হাজার কোটি, লাখো কোটি টাকার নয়ছয় ছেলের হাতে মোয়াই বটে। আর এভাবেই দুর্বৃত্তদের হাতে অর্থই হয়ে উঠেছে অনর্থের মূল- দেশ এবং দেশের মানুষ হয়ে পড়েছে বিপন্ন থেকে বিপন্নতর। দেরিতে হলেও অর্থমন্ত্রী সেই সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন বলে মনে হয়। দেশের ১২টি ব্যাংক ১৬শ কোটি টাকা পাচার করে দিয়েছে। ভুয়া এলসি খুলে সেসব এলসির বিপরীতে তারা দেশে যে পণ্য এনেছে তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো বস্তুগুলো হচ্ছে- ইটের গুঁড়া, আবর্জনাময় বালি, বিভিন্ন পণ্যের পোড়া অংশের ছাই, গুঁড়া পাথর ও সিমেন্টের ব্লক- ভাবা যায়? ভাবা না গেলেও এমন অভাবনীয় ঘটনাই ঘটে চলেছে এ দেশে। দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় এসব বস্তু আমদানি করে দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের ৭টি শিল্প প্রতিষ্ঠান এ কাজ করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
দেশের অর্থনীতিকে দুর্বৃত্তদের তৎপরতা থেকে মুক্ত করে সত্যিকার অর্থবহ করে তোলার জন্য প্রয়োজন অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তিকে আমলে নিয়ে দুর্বৃত্ত রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে অর্থ খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা। হলমার্ক কেলেংকারি, বেসিক ব্যাংক কেলেংকারি, শেয়ারবাজার কেলেংকারি, অর্থ পাচার কেলেংকারির সাথে জড়িত সব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করি, এদের শাস্তির ব্যবস্থা করে সরকার দেশের আর্থিক খাত ও অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে।