ভেজাল আর ভেজাল : খাদ্যদ্রব্যে অখাদ্যের মিশ্রণ

 

বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, পোড়াবাড়ির চমচমের জন্য যেমন এক সময় প্রসিদ্ধ ছিলো তেমনই চুয়াডাঙ্গার রসগোল্লা, পাবনার ঘি’র স্বাদে-গুণে যেমন সুনাম ছিলো তেমনই কদরও ছিলো দেশজুড়ে। এখন? বদলে গেছে স্বাদ-গন্ধ, পাল্টে গেছে ধারণাও। কেন? সুনামের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অর্থলিপ্সুরা ভেজালে ভেজালে ভরিয়ে তুলেছে। ভেজাল বলতে কি স্বাস্থ্যকর ভেজাল? এসব সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্যে এমন সব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ করা হচ্ছে যা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ঝুঁকি। বড়দের তাৎক্ষণিক মৃত্যু না ঘটলেও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি পদে পদে। ফলে খাদ্যদ্রব্য ভেজালকারীদের নমনীয় দৃষ্টিতে দেখা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভেজালকারীরা অবশ্যই জাতির শত্রু । দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই ওদের প্রাপ্য।

পচা আলু, পোড়া মবিল-গিরিস, ঘনচিনি দিয়েও ঘি প্রস্তুতের প্রমাণ মেলে, পত্রপত্রিকায় তা শিরোনামও হয়। এরই অংশ হিসেবে গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবনায় শুধু রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে দুধই তৈরি করা হচ্ছে না, দই-ঘিও তৈরি করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরে। ঈদকে সামনে নিয়ে ভেজাল দই দুধ ঘি কারবারীদের রমরমা ব্যবসা চলছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে গুটিকয়েক অর্থলিপ্সুর অর্থদণ্ডাদেশ দিলেও ভেজালকারবারীদের অপতৎপরতা বন্ধ হয়নি। অবাক হলেও সত্য যে, ঈদের বাজারে পাবনা ঈশ্বরদী এলাকার দই-ঘিতে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহের বাজার ছেয়ে যায়। এসব খাদ্যদ্রব্য আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি-না তা বোঝার উপায় থাকে না। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তার ছাড়পত্র দেয়ারও রেওয়াজ এখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। ফলে ভোক্তা সাধারণকে ওইসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খেয়ে পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগতে হয়। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে তৈরি করা ঘোষদের ঘি-দই নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। স্থানীয় অধিকাংশ ঘোষবাড়িতে দই-ঘি তৈরির স্থান কতোটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা দেখে কোনো ভোক্তারই ওতে রুচি নেবে না।

ঈদ সামনে করে শুধু টাকার নোটই যে জাল হয় তা নয়, গুঁড়ো মসলা থেকে শুরু করে কোন দ্রব্যসামগ্রী ভেজাল করা হয় না, হচ্ছে না তা খুঁজে পাওয়া ভার। ওষুধেও ভেজাল। রুগ্ন ছাগলও জবাইয়ের পর মাংসের রানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাসি বলে সিল পড়ে যায়। গুঁড়ো মসলায় শুধু পোড়ামাটিই নয়, আরো অকাট্য অখাদ্যের মিশ্রণও থাকে বলে জনশ্রুতি আছে, মাঝে মাঝে অভিযোগও উত্থাপিত হয়। ফলে ভোক্তা সাধারণকে আসল খুঁজে নিতে শুধু বেগই পেতে হয় না, অনেক সময়ই তাদেরকে চকচকে মোড়ক দেখে প্রতারিতও হতে হয়। দই-ঘি’র ঘ্রাণ নাকে নিয়ে বোঝার জো থাকে না, মূলত রাসায়নিক ফ্লেবার বা প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত কৃত্রিম গন্ধ প্রয়োগের কারণেই। যেমন আসল সরষের তেলের চেয়ে ভেজালটাতেই অধিক ঝাঁজ পাওয়া যায়। এক শ্রেণির অর্থলিপ্সুরাই মূলত ভেজালের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যখন ধরা পড়ার ঝুঁকি যেমন আছে বলে মনে করে না, তখন অন্যদের মধ্যেও তা সংক্রমিত হয়। ক্ষতিকর প্রবণতা এভাবেই তো ব্যাপকতা পায়, পেয়েছে। তার কুফল ওই ভেজালকারীদেরও যে ভোগ করতে হয়, হচ্ছে তা উপলব্ধিতে সুধরানোর বদলে অর্থলিপ্সতা ওদের বিবেক ভোতা করে রাখে। তা না হলে মানুষ হয়ে মানুষকে ওইসব খাওয়ায় কীভাবে? যদিও ভোক্তাদের সব কিছু সয়ে নেয়ার মানসিকতাও ভেজালকারীদের এতো বাড়বাড়ন্ত। ক’জন ভোক্তা দোকান থেকে দ্রব্য কেনার প্রমাণপত্র নেন? ভেজাল নিয়ে বাড়ি ফিরে প্রতারিত হলেও আইনের পথে হাঁটার সুযোগ থাকে না মূলত দোকান থেকে দ্রব্য কেনার প্রমাণপত্র তথা রসিদ না নেয়ার কারণে।

ভেজাল রুখতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। মাঝে মাঝে নয়, লাগাতারভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানোর পাশাপাশি হাট বাজারে ভেজাল শনাক্তকরণ যন্ত্র প্রশাসনের তত্ত্বাবধানেই রাখা যায় কি-না তা ভেবে দেখা দরকার। তা ছাড়া হোটেলে বা বাঁকে করে দই ঘি দুধ বিক্রেতাদের দ্রব্য কতোটা স্বাস্থ্যসম্মত তা শনাক্ত করেই বিক্রির ছাড়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা প্রয়োজন। অবশ্য ছাড়পত্র প্রদান ও যাচাইয়ের কাজে যাদেরকে নিয়োজিত করা হবে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে ভেজালের মাত্রা বাড়বে। জবাবদিহিতা না থাকলে ছাড়পত্রও যে ভেজাল হবে তা বলাই বাহুল্য। ভোক্তাসাধারণকে? শুধু সচেতন হলেই চলবে না, ভেজাল বর্জনে, ভেজাল রুখতে হতে হবে প্রত্যয়ী।