রাতারাতি বদলে গেছে মুস্তাফিজের পৃথিবী

স্টাফ রিপোর্টার: ম্যাচ শেষে মা মাহমুদা খাতুনের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিলো মুস্তাফিজুর রহমানের। ছেলের সাফল্য দেখতে দেখতে তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন মা। সেজ ভাই মোখলেসুর রহমান সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে তখন মুস্তাফিজকে ফোনে জানান, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন থাক, মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাল (সোমবার) সকালে কথা বলিস।’ সকালে উঠেই আগে মায়ের সাথে কথা বললেন বাংলাদেশের বীর। আত্মীয়স্বজন আর চেনা-অচেনা মানুষের ফোন ধরতে ধরতে মধুর বিড়ম্বনায় পড়েছেন মুস্তাফিজুর। এ বিড়ম্বনায় ভালো লাগাও রয়েছে।
টানা দু ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয় এনে দিয়েছেন তিনি। ইতিহাসের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকের পর টানা দু ম্যাচে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট করে। গত রোববার ভারত-বধের পর সংবাদ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে মধ্যরাতে হোটেলে ফেরে বাংলাদেশ দল। গতকাল বাংলাদেশ দলের অনুশীলন ছিলো না। এমন দিনে অনেকটা সময় ঘুমিয়েই কাটিয়েছেন ১৯ বছর বয়সী পেসার মুস্তাফিজ। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া হোটেলের লবিতে নামেননি। টানা দ্বিতীয় ম্যাচে জয়ের নায়ক হওয়ার পর ক্রিকেটার হওয়ার জন্য যাকে আদর্শ মানেন সেই মোখলেসুর ভাইকে মুস্তাফিজ জিজ্ঞেস করেন, আপনারা খুশি তো? ছোট ভাইয়ের কথা শুনে মোখলেসুর চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি। এদিকে গতকাল মুস্তাফিজ বলেন, অনেক ক্লান্ত। তার মধ্যেও ফ্রেশ লাগছে। অনেক ভালো লাগছে। ক্রিকেট ছাড়া অন্য সব বিষয় নিয়ে তার ভালো লাগার জায়গাগুলো খুবই কম। ঢাকা থেকে কালীগঞ্জ গেলে বাড়ি থেকে কোথাও নড়তে চান না। বলেন, ‘আমি তো বাইরেই ছিলাম, বাড়িতে যে ক’দিন থাকবো শুধু খাবো আর ঘুমাবো।’ সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জের তেঁতুলিয়া গ্রামে গত রোববার রাতের আনন্দ কিছুটা মাটি করে দিয়েছে বৃষ্টি। সেখানে টানা দুদিন বৃষ্টি হয়েছে। প্রথম ম্যাচ জয়ের পর তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে কালীগঞ্জ পর্যন্ত আতশবাজি পুড়িয়ে মুস্তাফিজুরের সাফল্য উদযাপন করেছে এলাকাবাসী। দ্বিতীয় ম্যাচে আরও বেশি আনন্দ করার ইচ্ছে থাকলেও বৃষ্টি বাধ সাধে।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে মুস্তাফিজুরের খুব বেশি পছন্দ-অপছন্দ নেই। ক্রিকেট খেলার সুবাদে বিদেশে গেছেন তিনি। তবে নির্দিষ্ট কোনো দেশে যাওয়ার লক্ষ্য নেই। বোলিঙে কীভাবে আরও ভিন্নতা আনা যায়, এ চিন্তা তার। কাল সকালে মোখলেছুর ভাইকে বলেছেন, ‘আর কী চান আপনারা।’ মোখলেসুর বলেন, এরকম পারফরম্যান্সই চাই। মুস্তাফিজ জানান, সামনের ম্যাচে আমার আরও ভালো করার লক্ষ্য রয়েছে।’ তার কোচ হিসেবে ভাই মোখলেসুর মুস্তাফিজকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, তোকে ওরা দু দিন খেলেছে। অনেক বল সম্পর্কে ওদের ধারণা হয়ে গেছে। তোকে আরও ভিন্নতা আনতে হবে।’ অনুশীলনে সব সময় প্রাণোচ্ছল থাকেন মুস্তাফিজ। বল করার সময় কোনো জড়তা থাকে না, উইকেট নেয়ার পর উদযাপনের ভঙ্গিটা অসাধারণ। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সময় ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ দিয়ে উত্তর শেষ করতে চান। ক্রিকেটের বাইরের জীবনটাও মুস্তফিজের একই রকম। বড়দের সামনে একেবারেই লাজুক। কিন্তু সমবয়সীদের সাথে দেখা হলে প্রাণখোলা আড্ডায় মেতে ওঠেন। দু দিনেই পৃথিবী বদলে গেছে তার। কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন দুটি পারফরম্যান্সের পর সবারই তো ভালো লাগে। সবাই জানতে চায়। শুভেচ্ছা জানায়, অনেক বেশি ভালো লাগছে।’ ছেলেকে নিয়ে মুস্তাফিজের বাবার আনন্দের শেষ নেই। কিন্তু এখন তিনি মুস্তাফিজকে গোটা দেশের ছেলে হিসেবে দেখছেন। গতকাল বলেন, ছেলের পারফরম্যান্সে আমি আনেক খুশি; কিন্তু সে এখন শুধু আমার ছেলে নয়- এখন সে বাংলাদেশের ছেলে।
এদিকে রহস্যময়ী এ পেসার শুরুতে কিন্তু অন্য চিন্তা করেছিলেন। তিনি নাকি ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিলেন। মুস্তাফিজ বলেন, আমি শুরুতে ওপরে ব্যাট করতাম। তখন মনে হতো ব্যাটসম্যান হবো। মুস্তাফিজ অনূর্ধ্ব-১৬, ১৮ ও ১৯ সাতক্ষীরা জেলা দলের হয়ে খেলেছেন।
মুস্তাফিজুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী: ব্যবসায়ী বাবা আবুল কাসেম গাজী, মা মাহমুদা খাতুন। মুস্তাফিজের জন্ম ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে। চার ভাই ও দু বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তার বড় ভাই গ্রামীণফোনের টেরিটরি অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। মেজ ও সেজ ভাই চিংড়ি মাছের ঘের ব্যবসায়ী। তার ক্রিকেট খেলায় আসার পেছনে সেজ ভাই মোখলেসুর রহমানের অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগে সাতক্ষীরায় অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেটে বাছাইপর্বে সে সবার নজর কাড়ে। তারপর তিন দিনের একটি কোচিং করানো হয় মুস্তাফিজকে। এরপর জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নামে সে। পড়াশোনায় বরাবরই সে কিছুটা অমনোযোগী। স্কুল ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে যেত। স্থানীয় বরেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে নেট অনুশীলন করত সে।’ এরপর মুস্তাফিজ অনূর্ধ্ব-১৬, ১৮ ও ১৯ সাতক্ষীরা জেলা দলের হয়ে খেলেছেন। সাতক্ষীরা গণমুখী সংঘের কোচ আলতাফ প্রথম খুঁজে পান মুস্তাফিজের মধ্যে ক্রিকেট প্রতিভা। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরও পরিণত করে তুলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরার জেলা কোচ মুফাসিনুল ইসলাম তপু। এরপর ডাক পান খুলনার বিভাগীয় দলে। গত বছরের মে’তে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। গত বছর এপ্রিলে তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরু করেন।