জীবনের ছবি বড্ড গোলমেলে : ঘাড়ের গামছায় চোখের পানি মুছে ওরা দোষ দিলেন ভাগ্যের

সকাল হওয়ার আগেই পথে বের হন অসংখ্য নারীশ্রমিক : পুরুষ দিনমজুরদেরও চোখেমুখে থাকে কাজ পাওয়া না পাওয়ার অনিশ্চয়তার ছাপ

 

সাইফ জাহান/খাইরুজ্জামান সেতু/আলম আশরাফ: নারগিস, মাসুরা, রাশিদা, পারভীনাসহ এরকম অনেক নামের চুয়াডাঙ্গার অসংখ্য নারী ঘুম থেকে ওঠেন আজানেরও অনেক আগে। সংসারের খুঁটিনাটি সেরে সামান্য কিছু খাবার বেঁধে ফজরের আজানের পরপরই বেরিয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। ফেরেন সূর্যাস্তের কিছুটা আগে। এ চিত্র শুধু রোজার মাসে নয়, সারা বছরের।

DSC09292

চুয়াডাঙ্গা জেলায় নারীশ্রমিকের সংখ্যা কতো? পরিসংখ্যানটা বেশ জটিল হলেও অনেকেরই দাবি, গুটি কয়েক কলকারখানায় যতোজন কাজ করেন তার চেয়ে কয়েকগুণেরও বেশি নারী এখন দিনমজুর। আর পুরুষ? চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কের কমলাপুর পিটিআই মোড়ে ভোরে পৌঁছুতে পারলে তার কিছুটা হলেও অনুমান করা যাবে। এ মোড়েই প্রতিদিন সকালে হাজারখানেক দিনমজুর সমবেত হয়। যাকে মানুষের হাট বললে মোটেও ভুল হয় না। শুধু পিটিআই মোড়ে নয়, চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বর, আলমডাঙ্গার কয়েকটি স্থানে যেমন প্রতিদিনই ভোরে দিনমজুরদের সমাবেশ ঘটে, তেমনই দামুড়হুদা, জীবননগর, সরোজগঞ্জ, বদরগঞ্জসহ ছোটখাটো মোড়েও দিনমজুরির কাজ পেতে জড়ো হন কিশোর থেকে বয়বৃদ্ধ দিনমজুর। আর চুয়াডাঙ্গার বেগমপুর, তিতুদহসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার অসংখ্য নারী দিনমজুর সকাল হওয়ার আনেক আগেই দলে দলে করিমন-নসিমনযোগে ছুটতে দেখা যায় মেহেরপুরের দিকে। হেঁটেও নারী দিনমজুরদের অনেকে হাজরাহাটি ও তালতলার মোড়ে জড়ো হতে দেখা যায়।

নারী দিনমজুরি কতো? পুরুষরাই বা সারাদিনের হাড়ভাঙা শ্রম বিক্রি করেন কতো টাকায়? কেনই বা দিনমজুর? এসব প্রশ্ন নিয়ে গত দুদিন ধরে চুয়াডাঙ্গার কয়েকটি স্থানে নারী ও পুরুষ দিনমজুরদের সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে তাদের অভাবের সাথে যুদ্ধের নানা বর্ণনা। কেউ বলেছেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কথা, কেউ বলেছেন অভাব নিয়েই জন্ম নেয়ার কথা। খুব কম মুখ থেকেই বেরিয়েছে শৈশবের ভুল আর অতি লোভে তাতি নষ্ট করার স্বীকারোক্তি। পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি, এ উক্তি ওদের কিছু প্রশ্নের কাছে ম্লান হলেও কেউ কেউ মাথা নিচু করে মেনে নিয়ে বলেছেন, ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর সুযোগ পেলাম কোথায়? দিনমজুরি ছাড়া যাদের গত্যান্তর নেই, কাজ না পেলে যাদের না খেয়ে থাকতে হয় তাদের কাছে কি ওরকম নীতিবাক্য মানায়?

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকা হাজরাহাটি-তালতলা। শুধু মাথাভাঙ্গার তীর ঘেঁষে নয়, বিস্তীর্ণ মাঠেও এখন অসংখ্য পানবরজ। এসব পানবরজে মাটি তোলা, পড় বাঁধা কাজের আশায় প্রতিদিন ভোরে অসংখ্য নারী এ দুটি গ্রামের দিকে ছুটতে থাকেন। বিকেল পর্যন্ত কাজ করে দেড়শো থেকে দুশো টাকা হাজরে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এদের মধ্যে ফার্মপাড়ার পারভীনা (৩৮), রঙ্গিলা (৫০), নারগিস (৩২), ইসলামপাড়ার মাসুরা খাতুন (৪২), রাশিদার (৪৫) সাথে কথা হয় গতকাল। রঙ্গিলার প্রথম স্বামী নিরুদ্দেশ হলে দ্বিতীয় বিয়ে করে নান্নুর সাথে। বিয়ের পর জানতে পারেন সেখানে সতিন রয়েছে। সুখ গেলে উবে। প্রায় ১০ বছর ধরেই পানবরজে মাটি তোলা, পড় বাঁধার কাজ করে পেট চালাচ্ছেন তিনি। নারগিসের স্বামী নেশাখোর। মারণনেশা হেরোইন তার সংসারের শান্তিই শুধু কেড়ে নেয়নি, মুখের আহারটাও কেড়ে নিয়েছে। অগত্যা তাকে পানবরজের দিনমজুরি করতে প্রতিদিনই ছুটতে হয় গ্রামের পথে। মাসুরা খাতুন স্বামী পরিত্যক্তা। খেতে দেবে কে? প্রথমে ঝিয়ের কাজ করলেও তাতে পোষায়নি। বেছে নিয়েছেন দিনমজুরি। রাশিদা-পারভীনাসহ প্রতিদিন আজানের সময় কাজের সন্ধানে পথে বের হওয়া এসব নারীর জীবনের ছবি বড্ড গোলমেলে। অধিকাংশই দরিদ্র ঘরের সন্তান, বাল্যবিয়ের শিকার। প্রতারিত হয়ে শৈশবে পুরুষের হাত ধরে সংসার পাতার স্বপ্নে স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে পিতার বাড়ি ছেড়ে কি ভুলটাই না করেছি! এরকম দীর্ঘশ্বাসও ছেড়েছেন কয়েকজন। কেউ কেউ বলেছেন, এলাকায় মিল-কলকারখানা থাকলে কি আর আমাদের মাঠে খাটার কাজে যেতে হতো?

চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের পল্লি বেগমপুর আকন্দবাড়িয়া, তিতুদহসহ পার্শ্ববর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য নারী নিজ এলাকার কৃষকদের কচুরমুখি তোলার কাজ করেন। অনেকেই দল বেধে ছোটেন মেহেরপুরের খাটো আবাদের জমিতে কাজের উদ্দেশে। সকাল হওয়ার বেশ কিছুটা আগেই চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের শহীদ হাসান চত্বর অতিক্রম করে ১৪/১৫ জন করে নারীশ্রমিক বহন করা নসিমন-করিমন। কোথায় যায় এরা? গতপরশু সকালে শ খানেক নারীশ্রমিক নিয়ে কয়েকটি করিমন চোখের সামনে দিয়ে ছুটছিলো মেহেরপুরের পথে। একটি থামাতেই নারীশ্রমিকদের অস্থিরতা ফুটে ওঠে। তাদের কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠলেন, ভাই আমাদের সময় নেই। সূর্যের তাপ বাড়ার আগেই মাঠে পৌঁছে ধনেপাতা তোলাসহ নানা কাজ করতে হবে। দেরি হলে হাজরে হবে না। এ কাজ করে প্রতিদিন দেড়শো থেকে দু আড়াইশ টাকা পর্যন্ত রোজগার করেন এ নারীশ্রমিকরা।

চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বরের পদ্মা জুয়েলার্সের সামনে দীর্ঘদিন ধরেই দিনমজুরদের সমাবেশ ঘটে। দিন দিন এদের সংখ্যা হ্রাস পেলেও বেড়েই চলেছে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কের পিটিআই মোড়ে। শহীদ হাসান চত্বরে কাজের জন্য বসে থাকা গাড়াবাড়িয়া ছাগলাপাড়ার লতিফ (৪৫), হানুরবাড়াদীর আজিজুল হক (৪০), মওলা বক্স (৬০), ইকবাল হোসেনসহ (৫০), কয়েকজনের সাথে কথা হয়। দিনমজুরি এখন আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা। কাজ বুঝে মজুরি। বয়স্কদের কদর নেই। গায়েগতরে যারা ভালো, যারা পরিশ্রম করতে পারবে বলে বিশ্বাস তাদেরই কাজে নেয়া হয় আগে। বয়সের ভারে যারা কাবু তাদের তেমন কেউ কাজে নেয় না বলে অনেকেই দিনমজুরি ছেড়ে ভিক্ষাবৃত্তিও শুরু করেছে বলে জানালেন গাড়াবাড়িয়ার কয়েকজন। মোতালেব দীর্ঘদিন ধরেই দিনমজুরি করতেন। অনেকের সাথেই প্রতিদিন ভোরে শহীদ হাসান চত্বরের সমাবেশে যোগ দিতেন। বয়সের ভারে কাবু। কাজে নেয় না কেউ। অগত্যা অন্যের কাছে হাত পাতা ছাড়া কি আর করার আছে? কেদের আলীরও একই দশা। ছেলেসন্তান থাকলেও তারা তাদের মতো সংসার পেতেছে। বৃদ্ধ পিতার খোঁজই রাখে না। বয়স হওয়ার পর দিন দিনমজুরদের অনেকেরই যে এ দশা হয়, হবে- তা বলতে গিয়ে কয়েকজন নিজেদের অজান্তেই ঘাড়ের ময়লা গামছাটা দিয়ে মুছে নিলেন চোখের নোনা পানি। দোষ দিলেন ভাগ্যের। ছোটবেলা থেকেই পরের গরু রাখা। তারপর মাঠের কাজ। এর আর শেষ নেই- এ দাবি ওদের।

কমলাপুর পিটিআই মোড়ে অসংখ্য পুরুষ দিনমজুরের সমাগম হয়। গতকালও ছিলো মোড়ে উপচে পড়া ভিড়। কারো হাতে কোদাল, কারো হাতে কাঁচি দা, ভোরে সকলেরই চোখেমুখে ছিলো অনিশ্চয়তার ছাপ। কৃষকদের অনেকেই এলেন- কেউ নিচ্ছেন ১০ জন, কেউ নিচ্ছেন ৫/৬ জন। যার যে ক’জন দরকার তা হিসেব করে নেয়ার সাথে সাথে কতো টাকা মজুরি দেয়া হবে তাও খানেকটা কৌশলে শুনিয়ে দিচ্ছেন। অপেক্ষমাণ দিনমজুরদের মধ্যে যাদের কাজ নিশ্চিত হচ্ছে তারা অনেকটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়েই কৃষকের সাথে হাঁটছেন বা ভ্যানে চাপছেন। অন্যদের যতোক্ষণ কাজের নিশ্চয়তা হচ্ছে না ততোক্ষণই যেন মুছছে না অনিশ্চয়তার ছাপ। মুছবে কীভাবে? দিনমজুরির টাকা দিয়েই তো স্ত্রী-সন্তানের জন্য চাল কিনে বাড়ি ফিরবেন। খাবার নিয়ে বাড়ি না ফিরতে পারলে বাড়িতেও যে শুনতে হবে অকম্মা অপবাদ। কাজ না পেলে কি করেন? এরকম প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কয়েকজন অভিন্ন ভাষায় বললেন, গ্রামে ফিরে মোড়ের দোকানে বিড়ি ফুকা ছাড়া আর কি করবো! অনাহারে থাকা সন্তানদের মুখের দিকে তাকালে নিজের ওপরই তো নিজেরই রাগ হয়। কেন যে গরিব হয়ে জন্মে ছিলাম!

অনেকেই গরিব ঘরে জন্ম নেয়। তাদের ক’জন গরিব থাকে? অনেকেই তো পরিশ্রম করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে। ঘোরায়নি? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে তেমন কেউই আগ্রহী নন। তাদের একজন বললেন, আপনাদের কি জোন (দিনমজুর) লাগবে? নাকি প্যাঁচাল পাড়তে এসেছেন? এ প্রশ্নের জবাবের বদলে লজ্জায় লাল হয়ে ফেরার পথে পুরোনো ভাবনাটা ফের ভর করলো। সত্যিই তো, দেশে দারিদ্র্য বিমোচন হবে কবে? কবে ঘুচবে ওদের অভাব!