শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেমিকেল যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে

স্টাফ রিপোর্টার: বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ল্যাবে ব্যবহৃত কেমিকেল এখন জঙ্গি সংগঠনের হাতে। ল্যাবের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জঙ্গি সংগঠনের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা দোকান থেকে এসব কেমিকেল নিয়ে যাচ্ছে। এর সাথে কেমিকেল বিক্রির দোকান মালিকদেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্যাডে লিখিত চাহিদার বিপরীতে এসব কেমিকেল জঙ্গি গ্রুপের সদস্যরা দোকান থেকে সংগ্রহ করতো। আর এসব বিস্ফোরক দিয়ে তারা তৈরি করে ভয়ঙ্কর বোমা।
জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরক সরবরাহের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ল্যাবরেটরি সহকারী ও তিন কেমিকেল ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ল্যাব সহকারী গাজী মোহাম্মদ বাবুল, টিকাটুলির কেমিকেল বিক্রির দোকান এশিয়া সায়েন্টিফিকের মালিক রিপন মোল্লা, ওয়েস্টার্ন সায়েন্টিফিক কোম্পানির ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন এবং এফএম কেমিকেলসের মালিক নাসির উদ্দিন। গ্রেফতারকৃতদের গতকাল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি।
ৱ্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে যেসব বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই তারা সংগ্রহ করেছে দেশীয় কেমিকেল গোডাউন অথবা কেমিকেল বিক্রির দোকান থেকে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে এসব জঙ্গি সংগঠনের কাছে কেমিকেল বিক্রি করে দিচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করা হলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে আবার একই ব্যবসা চালাচ্ছে।
গতকাল সাংবাদিক সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, গত ৭ জুন রাজধানীর বনশ্রী ও সূত্রাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ মাওলানা নুরুল্লাহ কাশেমী, তার ছেলে ফাহাদ বিন নুরুল্লাহ কাসেমী ওরফে ফাহাদ ওরফে কায়েস, দেলোয়ার হোসেন, ইয়াসিন আরাফাত, কাজী ইফতেখার খালেদ ওরফে খালেদ ওরফে ইফতি, রাহাত, দ্বীন ইসলাম, আরিফুল করিম চৌধুরী ওরফে আদনান ও নুরুল ইসলাম। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা ছয় কেজি বিস্ফোরক ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সম্পন্ন বোমা বানানো সম্ভব।
গ্রেফতারকৃতরা হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামিয়া বাংলাদেশ (হুজিবি) ও আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের বোমা বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্য। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছিলো, জঙ্গি কাজী ইফতেখার খালেদ ওরফে ইফতি ঢাবির ল্যাব সহকারী গাজী মোহাম্মদ বাবুলের কাছ থেকে বিস্ফোরক ও রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করে। এরপর বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, টিকাটুলির তিনটি রাসায়নিকের দোকান থেকে সে এসব কিনেছিলো। পরে ওই বিক্রেতাদেরও গ্রেফতার করা হয়।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার বলেন, ঢাকায় প্রায় সাড়ে তিনশ বৈধ রাসায়নিকের দোকান রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তারা যাচাই-বাছাই করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাসায়নিক বিক্রি করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্ধারিত প্যাডে রাসায়নিকের পরিমাণ উল্লেখ করে স্বাক্ষর করে নিজস্ব প্রতিনিধি দিয়ে তা কিনবেন। প্যাডে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর থাকবে। বিক্রেতা সেই নম্বর ফোন করে নিশ্চিত হয়েই কেবল রাসায়নিক উপাদান বিক্রি করবেন। কিন্তু বিক্রেতারা বাড়তি টাকার লোভে যাচাই-বাছাই না করেই বিক্রি করেছেন।
গ্রেফতারকৃত গাজী মোহাম্মদ বাবুল জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ইফতি ঢাবির মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক ছাত্র। এ পরিচয়েই তিনি ব্যক্তিগত গবেষণার প্রয়োজনের কথা বলে বাবুলের কাছে রাসায়নিক কিনতে চান। টাকার লোভে পড়ে তিনি তা সরবরাহ করতে সহযোগিতা করেছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে যুগ্ম-কমিশনার বলেন, বাবুল ও বিক্রেতারা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরক ও রাসায়নিক সরবরাহ করেন। তবে সেগুলো কি কাজে ব্যবহার হতো তা জানা ছিলো না বলেও দাবি তাদের। জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে তাদের আদর্শিক কোনো মিল আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঢাবির আর কেউ কোনোভাবে জঙ্গিদের সহায়তা করছেন কি-না তাও তদন্তে জানা যাবে।
ডিবির উপকমিশনার মাশরুরকুর রহমান বলেন, জঙ্গি বা রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য কারা বিস্ফোরকের যোগান দিতো, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছিলো। এর আগে অনুমান করা গেলেও ব্যবস্থা নেয়ার মতো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এবার প্রমাণ সাপেক্ষে তিন বিক্রেতাকে আইনের আওতায় নেয়া গেলো।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, ল্যাব সহকারী গাজী মোহাম্মদ বাবুলের সাথে জঙ্গি গ্রুপের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই ল্যাব সহকারী ৫ হাজার টাকার রাসায়নিক উপাদান ৯ হাজার টাকায় জঙ্গিদের কাছে বিক্রি করিয়ে দিতে সহায়তা করেছেন।
ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অবৈধ পথে বিস্ফোরক এনে খোলাবাজারে বিক্রি করছে এমন বেশ কয়েকজনের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এসব ব্যবসায়ীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। রাজধানীতে বিস্ফোরকের ৯৯৪টি গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ৮৬৭টির কোনো লাইসেন্স নেই। এসব গুদামে সালফার ও পটাশিয়াম নাইট্রেটের বিপুল মজুদ রয়েছে। এসব রাসায়নিক ও বিস্ফোরক কসমেটিকস, ওষুধ, সাবান, ম্যাচ ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এর আগে গত ২৬ মার্চ রাজধানীর দক্ষিণখানের একটি বাড়ি থেকে জেএমবির চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমির ও এহসার সদস্য আব্দুর রাজ্জাক হায়দার ওরফে মামুন, নওগাঁ জেলার আমির এবং গায়েরে এহসার সদস্য জিয়াউল বারী ওরফে ডালিম, দিনাজপুর জেলার আমির ও এহসার সদস্য কোরবান আলী ওরফে মোহাম্মদ আলী ওরফে হাঞ্জালা ও জেএমবির রংপুর জেলার অর্থ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে আর্জেস গ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেমিকেল উদ্ধার করা হয়।